আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সম্পন্ন হওয়া সব প্রকল্প ও চুক্তি বহাল রাখার ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। একই সঙ্গে যেসব প্রকল্প চলমান ও যাচাই-বাছাই পর্যায়ে রয়েছে, সেগুলো সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।
রোববার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, বিশেষ বিধানের অধীনে চলমান সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। আগে যেসব চুক্তি করা হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কারণ যেহেতু চুক্তি হয়ে গেছে তাই চাইলে তা বাতিল করা যাবে না। এজন্য আইনগত দিক খতিয়ে দেখতে হবে।
খাতসংশ্লিষ্টরা অবশ্য বলছেন, এরই মধ্যে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, সেগুলোর কারণে একদিকে ভোক্তার ওপর ভয়াবহ চাপ বেড়েছে, অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব শৃঙ্খলাও ভেঙে পড়েছে। বর্তমান প্রকল্পগুলোর চুক্তি সংশোধন ছাড়া বিদ্যুতের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
এর আগে ২০১০ সাল থেকে বিদ্যুৎ খাতে সক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বিশেষ আইনের আওতায় ১৪ দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। ভোক্তা পর্যায়ে দাম বেড়েছে ১৮৮ শতাংশ। এরপরও ২০০৮-০৯ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিক্রি করে ৭০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। পাশাপাশি সরকারি কোষাগার থেকে সংস্থাটিকে ভর্তুকি হিসেবে দেয়া হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বিদ্যুৎ, জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীনে চলমান সব ধরনের নেগোসিয়েশন, প্রকল্প যাচাই বা প্রক্রিয়াকরণ এবং ক্রয় পরিকল্পনাকরণ কার্যক্রম আপাতত বন্ধ থাকবে। তবে এ আইনের অধীনে এরই মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির আওতায় গৃহীত সব কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এ বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদকে অবহিত করে নেয়া হবে পরবর্তী সিদ্ধান্ত।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা সংস্থা পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, এই খাতের অপ্রয়োজনীয় যেসব চুক্তি করা হয়েছে সেগুলো রিভিউ করা যেতে পারে। এজন্য একটি রিভিউ কমিটি করা যেতে পারে। এর সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়কে সংযুক্ত করে তাদের মতামত নেয়া যেতে পারে।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিশেষ আইনের আওতায় শুধু বিদ্যুৎ খাতে ৯১টি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়। দেশে ১৫৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ হয়েছে এ আইনে। বিশেষ করে ২০১০ ও ২০১১ সালের দিকে বিদ্যুৎ খাতের রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল এ আইনের আওতায়।
সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সংসদে দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০টি কোম্পানি সবচেয়ে বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে সামিট গ্রুপ, ইউনাইটেড গ্রুপ, ব্যাংলা ক্যাট, আরপিসিএল, কেপিসিএল, মোহাম্মদী গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠান। তারা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বাবদ অন্তত ৪৪ হাজার কোটি টাকা বেশি নিয়ে গেছে।
ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) বাংলাদেশের জ্বালানি খাতবিষয়ক লিড অ্যানালিস্ট শফিকুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো অ্যানালাইসিস করে এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা যায়। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করে খরচ কমানো যেতে পারে। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায়, অন্যান্য খরুচে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করে দেখার সুযোগ আছে কিনা, সেটি দেখতে হবে।
দেশে অনুমোদন এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র তিস্তা সোলার লিমিটেড। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো পাওয়ার লিমিটেড এটি নির্মাণ করেছে। গত ডিসেম্বর থেকে কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে জাতীয় গ্রিডে। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় অনাবাদি চরের ৬৫০ একর জমিতে ২০১৭ সালে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়।
আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি সরবরাহের চুক্তি করে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেটের সঙ্গে। বিশেষ বিধানের আওতায় দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে ৪৮টি কূপ খননের প্রকল্পও বাস্তবায়িত হচ্ছে। তবে এখানেও চীন ও রাশিয়ার কোম্পানিগুলোকে স্থানীয় কোম্পানি বাপেক্সের চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি দামে কাজ দেয়ার অভিযোগ।
বিশেষ আইনটি বাতিলের প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, এজন্য উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে যে সিদ্ধান্তই নেয়া হোক তাতে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন থাকবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘বিশেষ আইনের আওতায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চলমান প্রকল্প স্থগিত রাখা হয়েছে এটি ভালো উদ্যোগ। তবে আইনটির আওতায় যেসব কাজ হয়েছে এখন সেগুলো যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। তাহলে জনসাধারণ জানতে পারবে এগুলোর বিদ্যুৎ খাতে আর্থিক সফলতা রয়েছে কিনা। না থাকলে এগুলোর বিষয়ে একটা সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে হবে।’
ডিবিএন/ডিআর/তাসফিয়া করিম