( ১ ম পর্ব ) বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার নামকরণের ইতিহাস বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে বঙ্গদেশ বা বাংলা’র নামকরণ ও ব্যুৎপত্তি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত খোঁজ-খনন যথার্থই প্রয়োজন। একইভাবে অধিবাস স্থাপনের সংক্ষিপ্ত ইতিকথাও জানা দরকার।পাঠকদের জানার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের জেলা নামকরণের ইতিহাস নামক বই থেকে সংগৃহিত লেখাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করছি। যেকোন জাতি বা দেশ তার স্বকীয়তায় যেমনি রাতারাতি পূর্ণতা পায়না,তেমনি সহ¯্র বছরের বিস্তৃতির মধ্যে বহু আবর্তন-বিবর্তনের ভেতর দিয়ে একটি ভাষা লাভ করে শক্তিশালী রুপ। আজকের নদীমাতৃক পলিসমৃদ্ধ বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষার জন্মের সূচনাক্ষেত্রেও এই কথাটি খুব ভালোভাবে পযোজ্য। ভৌগলিকভাবে এই ব-দ্বীপটির আবস্থান এমন একটি জায়গায়,যার উত্তর দিকে ঘাড় ভেঙে দেখতে হয় সুউচ্চ হিমালয়,আবার দক্ষিণে ঘাড় নুয়ে দেখতে হয় সুগভীর বঙ্গোপসাগর। হিমালয়ের উৎপত্তি তিনটি যুগে ব্যাপ্ত। এই যুগত্রয় হলো ইয়োসিন, মধ্যে মাইয়োসিন ও মাইয়োসিরনোত্তর যুগ থেকে প্লাইস্টোসিন যুগের ব্যাপ্তিকাল আনুমানিক দশ লক্ষ বছর। তৃতীয় হিমবাহর কালে বা শেষ প্লাইস্টোসিন যুগের আমল থেকেই বাংলাদেশের উৎপত্তি। এর উৎপত্তিকালের সূচনা হয়েছিল প্রায় তিন লক্ষ্য বছর আগে। হিমালয়ের উৎক্ষেপণকালে এর দক্ষিণাংশে একটি নি¤œভাঁজের সৃষ্টি হয়। কালের প্রবাহ গঙ্গা ও ব্রক্ষপুত্রের পলিমাটির স্তরসজ্জায় বাংলার ব-দ্বীপ গড়ে ওঠে। এতদঞ্চলে মনুষ্যবসতি স্থাপন বিষয়ে বিভিন্ন মত পোষণ করা হয়। তবে এযাবৎকালের এষণালধ্ব ধারণা হলো,দুটি সময়পর্বে এখানে মানববসতি গড়ে ওঠে। প্রথম সময়টির নাম প্যালিওলিথিক, দ্বিতীয় সময়টি হলো লৌহ যুগ। এই সময় আর্যরা ভারত উপমাহাদেশে আসে। সমুদ্রোপকূলবর্তী হওয়ায় বাংলার ব-দ্বীপ অঞ্চলের আবহাওয়া তুলনামূলকভাবে কম শীতের ছিল। তখন উত্তরাঞ্চলীয়রা অসহ্য শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাবার প্রয়াসে প্রধানত পার্বত্য অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। এরাই বর্তমান বাংলাদেশে চাকমা, গারো, কোচ, হাজং, খসিয়া বলে অনুমিত হয়। এছাড়াও অস্ট্রো-এশিয়াটিক বলে পরিচিত বাংলাদেশের যে আদিম মানবের ইতিহাস পাওয়া যায়, তারা বহু পূর্ব থেকেই দ্বীপটির প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা ছিল। সম্ভবত এরাই আজকের ‘বুনো’, সাঁওতাল, কৈবর্ত গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ। এক্ষেত্রে আরো একটি পৃথকীযোগ্য গোত্রের কথা উল্লেখ্য। যারা বর্তমানে বেদে বা যাযাবর বলে পরিচিত। প্রাচীন গ্রীক ভাষায় যাযাবরদরে ‘ম্লেস্ট’ বলা হয়। পরবর্তীতে বৈদিক যুগে প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে বাংলাদেশিদেরকে দেওয়া স্লেস্ট বিশেষণটি কেবল সমান অর্থবোধকই নয়, প্রায় সমোচ্চারণও বটে। অধিকাংশ জঙ্গলাকীর্ণ এই বাংলায় ম্লেচ্ছরা স্থলের বন্যপশুর উপদ্রপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিরাপদে নৌকায় বসবাস করতো।আবার এমনও উল্লেখ পাওয়া যায়যে তাদের মধ্যে অনেকে স্থলবাষী কৃষিজীবী চিল। তাহলে এই সিদ্ধান্তে আসা যায়, বাংলাদেশে অস্ট্রো-এশিয়াটিকের একটি শাখা স্থলে এবং একটি শাখা জলে বাস করতো। কোন কোন গ্রন্থে বঙ্গদেশী বিষয়ে বলা হয়েছে সমুদ্রোপকূলবর্তী মাছ-ভাতখেকো কৃষ্ণকায় এক দস্যুজাতীয় আবাস এখানে। নদীর ভাঙাগড়ায় ও বারংবার গতি পরিবর্তনের ফলে ভৌগলিক সীমানা বহুবার পরিবর্তীত হয়েছে, তৎকালীন বঙ্গ বলতে বাংলার এই পলিগঠিত ব-দ্বীপ এবং কুমিল্লার লালমাই পর্বতসংলগ্ন অঞ্চল নিয়ে গঠিত অংশকে বোঝাতো। নদীর সীমানা দ্বরা বিভক্ত রাঢ় ও বরেন্দ্র অঞ্চলগুলো ছিল উচ্চ ও শুল্ক। ফলে এখানে সহজেই আর্যরা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। বোঝা যায় যে, বঙ্গের আদিবাসীদের ধর্ম ছিল আর্যধর্ম। মহাভারতের কাল থেকে ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি’র শাসন পর্যন্ত এদেশে এসেছে বহু জাতের বণিক এবং শাসক। অভিযোজনের সাহায্যে বারংবার পরিবর্তীত বঙ্গপরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে শাসনকার্যে কেউ হয়েছে জয়ী, কেউবা ব্যর্থ হয়ে অবলুপ্তির মাধ্যমে দিয়েছে মাশুল। মানুষের যৌনতা এক ধরণের সংক্রামক উগ্র-প্রকৃতি। তাই এইসব বিদেশী বণিক ও শাসকদের আগমনের ফলে বাঙালি জাতীয় গঠনক্ষেত্রে যেমন তাদের সংমিশ্রণ ঘটেছে, তেমনি তার প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে বাংলাভাষার ওপরেও। কেননা সাংস্কৃতির চারিত্র্যই হলো সংক্রমিত হওয়া। ইতিহাসবেত্তাদের মতে, খ্রিস্টপূর্ব পাঁচশ অব্দ থেকে এইদেশ বিদেশী রাজ্যের সাথে জলপথ-বাণিজ্যে খ্যাতিলাভ করেছিল। এদেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ক বিস্তৃত হয়েছিল বার্মা, মালয় এবং সুদূর প্রাচ্যের সাথেও। বঙ্গের আদিবাসীরা ছিল অস্ট্রিক ও তিব্বতীয়। এরপর এলাকাটি হিন্দু শাসনাধীনে তাদের সংস্কৃতিতে প্রভাবিদ হতে থাকে। ১২০০ শতকের শেষপাদে বাংলার শেষ হিন্দু শাসক লক্ষণ সেন (আনু ১১৭৮-১২০৬) বখতিয়ার খিলজির (-১২০৬) কাছে পরাজিত হন। রাজধানী নদীয়া দখলের মাধ্যমে ১২০১ সালে খিলজি বঙ্গদেশে প্রথম মুসলিম শাসনের সূত্রপাত ঘটান।১৩০০ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম উত্তরবঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গ তুর্কী শাসনাধীনে আসে। সেন রাজত্বকালে বঙ্গে বৌদ্ধধর্মের বিশেষ প্রসার ঘটেছিল।এর কারণ হলো, সম্প্রদায়ভুক্তদের প্রতি উপেক্ষা, অন্যদিকে বৌদ্ধ ধর্মবিরাগই জনগণকে একীভুত করেছিল। হুসেন শাহের ( ১৫ শ ১৬ শ শতক) সময়ে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে নবদিগন্তের সূচনা হয়। ইতিপূর্বে মানুষের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মবোধ যেমন একাত্মতা এনেছিল, হুসেন শাহের আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধির সোপান বেয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজও তেমনি অঙ্কুরিত হয়েছিল। এই ১৩০০ শতাব্দীতেই বিগত চার দশক জুড়ে আরাকানিরা ( মগ) বাংলার উপকূলবর্তী এলাকা আত্রুমণ ও আধিকার করে। ফলে বাঙালি রক্তে আরাকানি মিশ্রণ ঘটে। এইভাবে বাঙালি রক্তধারায় মিশেছে পর্তুগিজী রক্ত। এরও অনেক আগথেকে বঙ্গদেশের সেই আদিবাসী তিবেতোÑবর্মণ, আস্টোÑএশিয়াটিক এবং দ্রাবিড়দের রক্তে এবং সংস্কৃতিতে যাদের রক্ত ও সাংস্কৃতিক মিশ্রণ ঘটেছে, তারা হলো আর্য, পান্ডব,বর্মী, মালয়ী, সিংহলী, অসমীয়, দক্ষিণ চৈনিক, আবগানী, মোঙ্গলীয়, সেমেটিক, আরবীয়, তুর্কী, আবিসিনীয় (নিগ্রো, হাবসি), শক, হুন, মারাঠি (বর্ঘী), পাঠান, পর্তুগিজি( ফিরিঙ্গি),ডাচ(ওলন্দাজ), ফরাসি, ইরানি, হিন্দি, সংস্কৃত, তাতার, পার্সিয়ানা,চান্দ্রি, জাপানি, তিব্বতি, বেলুচি, পাঞ্জাবি, তামিল, তেলেগু ইত্যাদি।এইভাবে প্লায়স্টোসিন যুগ হতে হাজার হাজার বছরের নদীবাহিত পলিতে বাংলাদেশের সৃষ্টি।চলবে————