আট বছর আগে, ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক চিরাচরিত রূপ থেকে দ্বিপক্ষীয় কৌশলগত সহযোগিতায় উন্নীত হয়েছিল। এ সম্পর্ককে আরো এগিয়ে নিয়ে পারস্পরিক রাজনৈতিক নির্ভরশীলতাকে আরো গভীর কৌশলগত অংশীদারত্বে রূপ দিতে চাইছে ঢাকা এবং বেইজিং।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের বেইজিং সফরে চীন এ সম্পর্ককে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে ‘নিবিড় কৌশলগত অংশীদারত্বে’ রূপ দিতে চাইছে।
আট বছর পূর্বে শি জিনপিংয়ের ঐ সফরের মধ্য দিয়ে চীনের অঞ্চল ও পথের উদ্যোগে (বেল্ট ও রোড ইনিশিয়েটিভ) যুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশ। এবার চীনের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (জিডিআই) বাংলাদেশ যুক্ত হবে। আর বাংলাদেশের পরিকল্পিত দক্ষিণাঞ্চলীয় সমন্বিত অবকাঠামো উদ্যোগে (সিডি) চীনের যুক্ততার ঘোষণা আসতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরে ঢাকা আরো কিছু বৈশ্বিক কার্যক্রমে যুক্ত হবে বলে আশা করে বেইজিং।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কৌশলগত কারণে ঢাকা চাইলেই চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ককে গভীর করাকে দৃশ্যমান করতে পারবে না। ফলে উন্নয়ন অংশীদারিত্ব যত বাড়বে, দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের পারস্পরিক নির্ভরশীলতাও তত বাড়বে। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরের যৌথ বিবৃতিতেও এর প্রতিফলন থাকবে।
সম্পর্কের উন্নয়ন
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, এবারের সফরে স্বাগতিক দেশ চীন তাদের যৌথ বিবৃতির খসড়ায় সম্পর্ক উত্তরণে ‘নিবিড় কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্বের’ প্রস্তাব করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে মনোযোগী চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)। সম্প্রতি ঢাকা সফরে এসে এই বার্তাই দিয়ে গেছেন সিপিসির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানছাও।
সামগ্রিকভাবে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের উত্তরণ আর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নিবিড় করার বিষয়টি যৌথ বিবৃতিতে প্রতিফলিত হবে— সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
দুই দেশের মধ্যকার লেনদেন
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাসহ ডলার সংকটের কারণে বিশ্বের অনেক দেশ বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা করে আসছে। বাংলাদেশও এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
এরই মধ্যে ঢাকা ও বেইজিং দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে সরাসরি লেনদেন নিষ্পত্তি চালুর জন্য আলোচনা এগিয়ে নিয়েছে। পিপলস ব্যাংক অব চায়নায় একটি হিসাব খোলার বিষয়ে দুই দেশ সম্মত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বার্তা প্রেরণের মাধ্যম সুইফটের বিকল্প হিসেবে চীনের সিআইপিএসে যুক্ত হয়ে এ লেনদেন করা হবে।
এ নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল গত ২ জুলাই চীন গেছে বলে জানা গেছে।
কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে সরকার বেশ কয়েক বছর আগে উন্নয়ন অবকাঠামো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় সরকার পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ (সিডি) নিচ্ছে। বাংলাদেশ চাইছে সিডি বাস্তবায়নে অংশীদার হোক চীন। এ বিষয়ে এরই মধ্যে বেইজিংয়ের রাজনৈতিক মহলসহ নানা স্তরে বাংলাদেশের প্রত্যাশার বিষয়টি জানানো হয়েছে বলে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে। এরই মধ্যে পটুয়াখালীতে নবম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মাণ করছে দেশটি। আর অঞ্চলটি চলতি বছরের এপ্রিলে গিয়ে সরেজমিন দেখে এসেছেন ঢাকার চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন।
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ সহায়তা
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের চীন সফর উপলক্ষে অর্থ-সংক্রান্ত বড় ধরনের সহায়তা আশা করছে বাংলাদেশ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এর সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প সহায়তা নিয়েই এখন পর্যন্ত কথা হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে কী পরিমাণ ঋণ সহায়তা চাওয়া হবে, তাও এখনো নির্ধারিত হয়নি। কতটি প্রকল্পকে চীনা ঋণের আওতায় আনা হবে, সেটা নিয়ে কাজ চলছে। সুতরাং প্রকল্প সংখ্যা নির্ধারিত হওয়ার আগে ঋণের পরিমাণও সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না।
ইআরডির সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এক সভায় নতুন মেট্রোরেল প্রকল্প নির্মাণে অর্থায়নে আগ্রহের কথা জানায় চীনা পক্ষ। ৬০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে ৪৫ হাজার কোটি টাকার মতো দেবে চীনের এক্সিম ব্যাংক।
মেট্রোরেল ছাড়াও ভাঙা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের প্রকল্পেও চীনের আগ্রহ বেশি। এ ছাড়া পিরোজপুরে কচা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ এবং মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর সেতু মেরামতে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে অর্থ পেতে চায় বাংলাদেশ।
চীনা ঋণ পেতে রেলের আরো যেসব প্রকল্পের তালিকা করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আছে– গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে জামালপুর পর্যন্ত মিশ্র গেজ রেলপথ নির্মাণ, পাবনার ঢালারচর থেকে ফরিদপুরের পাচুরিয়া পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ, রাজবাড়ীতে একটি রেলওয়ে ওয়ার্কশপ নির্মাণ এবং ভৈরববাজার থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত মিটারগেজ লাইন মিশ্র গেজে রূপান্তর।
ডিবিএন/ডিআর/তাসফিয়া করিম