বাঙালি বরাবরই স্বাধীনচেতা জাতি। বীরত্বপূর্ণ লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস এ জাতির গৌরবময় ঐতিহ্যেরই অংশ। তবুও ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বাঙালির জন্মভূমি হয়েছে বহিরাগত শাসক-শোষকদের করতলগত। হানাদার বিদেশী শাসকরা বারবার আক্রমণ ও দখল করেছে এ দেশের শাসনদ-, লুণ্ঠন করেছে সম্পদ, শোষণ-নিষ্পেষণে করেছে জর্জরিত। কিন্তু কোনোভাবেই পারেনি বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে কেড়ে নিতে। তাই সুযোগ পেলেই এ দেশের মানুষ করেছে বিদ্রোহ। বিশাল শক্তিমত্তা জেনেও অসীম সাহসে নেমেছে অসম লড়াইয়ে। বাঙালির এই লড়াই-সংগ্রামেরই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭১ সালে।একটি সংকল্পবদ্ধ জাতি সশস্ত্র সংগ্রাম করে কেবল নয় মাসের মধ্যে একটি বহুতল শক্তিশালী ও আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত দখলদার বাহিনীকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করে দেশ স্বাধীন করে। সম্পূর্ণ পযুদস্ত ৯৩ হাজার পাক বাহিনী আজকের দিনে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম দুই দশকে বিসতৃত ছিল। এগিয়েছিল ধাপে ধাপে। ভাষা আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচনের পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই দেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়লে একটি জনযুদ্ধের আদলে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা ঘটে।১৯৭১ সালের ১ মার্চ কোন কারণ ছাড়াই ৩ তারিখের নির্ধারিত অধিবেশন বাতিল করা হয়। ক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ধৈয্যের শেষ সীমা ছাড়িয়ে গেল এই সিদ্ধান্ত। সারা দেশে বিক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়। ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। বঙ্গবন্ধু সারা দেশে ৫ দিনের হরতাল এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তার আহবানে সারা পূর্ব পাকিস্তান কার্যত অচল হয়ে যায়। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণে তিনি ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগেই বাস্তবায়নের জন্য চার দফা দাবি পেশ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল ১৯৭১ সালে সংঘটিত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র সংগ্রাম, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে পৃথিবীর মানচিত্র আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা রাজধানী ঢাকার বুকে সর্বশক্তি নিয়ে হিংস্র পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র মানুষের উপর, খুন করেছিল হাজার হাজার নর-নারী, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করেছিল অসংখ্য ঘর-বাড়ি, পুলিশ-বিডিআর সদর দফতরসহ অসংখ্য স্থাপনা, শহীদ মিনার এবং সেই সঙ্গে বেশ কয়েকটি পত্রিকা অফিস। মহা আক্রোশে তারা কামান দেগেছিল জাতীয় প্রেসক্লাবে। দৈনিক সংবাদ অফিসে আগুন লাগিয়ে তারা জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল সাংবাদিক-সাহিত্যিক শহীদ সাবেরকে। সেই অবস্থায় ঢাকার সকল পত্র-পত্রিকা হয়ে গিয়েছিল পন্ড। সেসময়ে সত্যের প্রকাশ হয়ে পড়েছিল সম্পূর্ণ অসম্ভব। সাধারণ মানুষ নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল অন্ধকারে। বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক মাধ্যমেই কেবল বাংলাদেশে ঘটতে থাকা ঘটনাবলীর কিছুটা প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানী হানাদাররা যেহেতু বিদেশী সাংবাদিকদেরও দেশ থেকে বের করে দেয় এবং নিষিদ্ধ করে বিদেশী সংবাদকর্মীদের এ দেশে প্রবেশ, কাজেই তখন সাধারণ নাগরিকদের সঠিক তথ্য পাওয়ার পথও বন্ধ হয়ে যায়।এর পরিণামে যা হওয়ার তা-ই হয়েছিল। অনেক সাংবাদিককেই দেশত্যাগ করতে হয়েছিল। কেউ কেউ রাজধানী ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিলেন।ফলে যেখানেই সম্ভব হয়েছে, বিশেষ করে যে সমস্ত এলাকায় তখনও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি, সেই সব জায়গায় সাংবাদিক-অসাংবাদিক নির্বিশেষে দেশপ্রেমিক মানুষেরা তাদের সামর্থ্যমত পত্র-পত্রিকা প্রকাশের চেষ্টা চালিয়েছে। সে সময় পত্রিকার কাগজ বা মুদ্রণ প্রায়ই খুব উচ্চমানের হত না, সেগুলোর প্রকাশনাও সব সময় নিয়মিত ছিল না। পাকিস্তানী সৈন্যরা সেসব এলাকায় হামলা চালালে হয়ত সেগুলোর প্রকাশ সঙ্গত কারণেই বন্ধ হয়ে যেত। এসব পত্রিকার অনেকগুলোই প্রকাশিত হয়েছিল নিয়মিত মুদ্রণের পরিবর্তে সাইক্লোস্টাইল করে।শুধু মাত্র মেশিনে ছাপা পত্রিকা দুটির নাম ছিল যথাক্রমে অগ্নিবাণ ও গ্রেনেড। উল্লিখিত পত্রিকা দুটির নাম থেকেই অনেকটা বোঝা যায় যে, এগুলো সংগ্রাম তথা সশস্ত্র যুদ্ধ চলাকালীন প্রকাশিত পত্রিকা। যেখানে যেমন ধরনের বা মানের মুদ্রণযন্ত্র পাওয়া গেছে, মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিকরা তাই ব্যবহার করেছে। ফলে অনেক পত্রিকাকেই হয়ত মানোত্তীর্ণ বলা যাবে না, তবে তাদের প্রচারিত তথ্যে ও লেখায় মুক্তিযোদ্ধাসহ সকল দেশপ্রেমিক বাঙ্গালী দারুণ উজ্জীবিত হয়েছে। এইসব সাংবাদিক-লেখকের মধ্যে অনেকেই একহাতে স্টেনগান রেখে অন্য হাতে পত্রিকার জন্য লিখেছেন। এই সাংবাদিকরা ছিলেন যথাসম্ভব সত্যনিষ্ঠ এবং কাজটিকে তারা মুক্তিযুদ্ধের অংশ হিসেবেই বিবেচনা করতেন। । মুজিবনগর সরকার যদিও দেশের অভ্যন্তরেই গঠিত হয়েছিল, কিন্তু দেশের এক কোটি মানুষের সঙ্গে উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল অনেক সংবাদ কর্মীদেরও। তবে তারা খবর সংগ্রহের জন্য প্রায়ই সুযোগ বুঝে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেন। এক্ষেত্রে দেশের ভেতর যুদ্ধরত গেরিলারা তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতেন। তবে শত্রুর পাশাপাশি গোপনে অবস্থান করেও এই অসমসাহসী গেরিলারা তাদের প্রকাশনার কাজ চালিয়েছেন। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকাগুলোর অবদানকেও খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য সেইসব মুক্তিযোদ্ধারা, যারা বাইরের কোন সাহায্য ছাড়াই স্থানীয়ভাবে অর্থ যোগাড় করে শত্রুবেষ্টিত এলাকায় ভয়ানক ঝুঁকি নিয়ে পত্রিকা বের করেছেন এবং সেগুলো গোপনে বিতরণের ব্যবস্থা করেছেন। বাংলাদেশের সেই সময়ের বড়-ছোট নানা রাজনৈতিক দল তাদের মুখপত্র হিসেবে পত্রিকা বের করেছিল। আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল জয়বাংলা পত্রিকা। এটি অবশ্য সরকারী অনুদানও পেত। এছাড়া ও পত্রিকার মধ্যে ছিল, বাংলাদেশ নামে সাতটি, স্বাধীন বাংলা নামে ছয়টি, বাংলার ডাক নামে দুইটি, মুক্তবাংলা নামে দুইটি, মুক্তি নামে দুইটি,রণাঙ্গন নামে তিনটি, সংগ্রামী বাংলা নামে দুইটি এবং সোনার বাংলা নামে তিনটি পত্রিকা। কোন কোন সম্পাদক ছদ্মনাম ধারণ করলেও অন্যরা নিজ নামেই পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। মওলানা ভাসানীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল গণমুক্তি নামক পত্রিকা। এছাড়া সিকান্দার আবু জাফর অভিযান পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আহমদ রফিক ছিলেন আওয়ামী লীগের মুখপত্র জয়বাংলা-এর সম্পাদক, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ নতুন বাংলা-এর সম্পাদক এবং দেশবাংলা নামক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ফেরদৌস আহমদ কোরেশী।এছাড়া ওরা দুর্জয় ওরা দুর্বার, উত্তাল পদ্মা, দাবানল, বাংলার ডাক, বিপ্লবী বাংলাদেশ, মায়ের ডাক, রণাঙ্গন, লড়াই, সংগ্রামী বাংলা ইত্যাদি নামের পত্রিকা গুলোও উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যেমনি, তেমনি বাংলাদেশের সাংবাদিকতা তথা গণমাধ্যমের ইতিহাসে এই সমস্ত পত্র-পত্রিকা ও বেতার কেন্দ্রটির ভূমিকা বিশদভাবে উল্লেখ করতে হবে। এগুলোর পেছনে যে দেশপ্রেম, যে নিষ্ঠা কাজ করেছে, তা এক কথায় অতুলনীয়। দেখা গেছে যে, কয়েকজন তরুণ একত্রিত হয়ে নিজেদের সাধ্যমত কিছু অর্থ জোগাড় করে পত্রিকা প্রকাশের মত দু:সাহসিক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এছাড়া এমনও অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে যে, এই ধরনের পত্রিকা বিলি করার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকারদের চোখ এড়িয়ে পত্রিকা বহন করে নিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধেও সাংবাদিকতার এই ইতিহাস ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে । তাই মহানস্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া কলম সৈনিক দের কথা পাঠক শ্র“তাদের জানানোর জন্য সংগ্রহ কৃত তথ্যথেকে সংক্ষিপ্ত আকারে তা তুলেদরলাম। বাঙ্গালীর ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনার নায়ক অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের সহযাত্রী হিসেবে কলম যোদ্ধাদের অবদানও অক্ষয় হয়ে থাকুক, এবং আগামি প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানুক সেই কামনাই জাতির ঐ সংগ্রামে অসিমসাহসিকতার পরিচয় দেওয়া গণমাধ্যম ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান জানানোর সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাসে তাদেরকে অন্তরভুক্ত করার জন্য জুর দাবি জানাচ্ছি । লেখকঃ মোঃ নাছির উদ্দিন চৌধুরী সাংবাদিক ও মানবাদিকার সংগঠক মোবাইল নংঃ ০১৮২৪ ২৪৫৫০৪