বাংলাদেশের চট্টগ্রাম হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষী। এই চট্টগ্রামকে বলা হয় বাণিজ্যিক রাজধানী। কর্ণফুলী নদীর মোহনায় বঙ্গোপসাগরের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান। সমগ্র পৃথিবীর মানুষের সাথে সমুদ্র পথের যোগাযোগের প্রাচীনতম ঠিকানা। দেশ-বিদেশের পর্যটক, নাবিক ও বণিকগণ বিভিন্ন সময়ে এই সমুদ্র বন্দরকে ব্যবহার করেছে। পৃথিবীর বিখ্যাত বিখ্যাত ইতিহাস ও মহামনীষীদের ইতিহাসে উঠে এসেছে এই চট্টগ্রাম বন্দরের কথা। চট্টগ্রাম বন্দর মানেই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের উন্নয়নের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের অবদান অপরিসীম। চট্টগ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরার লক্ষ্যে আধুনিক বিশ্বের যুগোপযোগী বন্দর হিসেবে গড়ে তোলা। বাংলাদেশ স্বাধীন পরবর্তী প্রত্যেকটি সরকারের বন্দরের উন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন। বর্তমান আওয়ামী লীগের সরকার ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এই বন্দরের উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের পশ্চিম দক্ষিণে মহেশখালীতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ চট্টগ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের একটি দাবি। চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তর-পূর্বে পর্বতশ্রেণী থেকে উৎপন্ন এবং বঙ্গোপসাগরে পতিত কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত। সমুদ্র হতে কয়েক মাইল অভ্যন্তরে গভীর সমুদ্রে নোঙর করার সুবিধাই এ বন্দরের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বঙ্গোপসাগরের বাইরের দিকে বালুচর হতে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে প্রধান ঘাট পর্যন্ত চলমান দূরত্ব হচ্ছে ১৬ কিলোমিটার। বন্দরের অবস্থান এবং এর স্বাভাবিক পোতাশ্রয় একে খ্রিস্টীয় নয় শতক হতে ব্যবসা-বাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত করেছে। ঐ সময় আরব বণিকদের নিকট এটি ছিল লাভজনক বাণিজ্য কেন্দ্র। পনেরো শতকের শুরু থেকেই চট্টগ্রাম বন্দর ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। চৈনিক পর্যটক মাহুয়ান এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ১৪০৫ সালে চট্টগ্রাম আসেন। তিনি চট্টগ্রামকে (চিট-লে-গান) একটি বন্দর হিসেবে উল্লেখ করেছেন যেখানে চৈনিক বাণিজ্যিক জাহাজ প্রায়শ যাতায়াত করত। ইউরোপীয়দের মধ্যে পর্তুগিজরাই প্রথম চট্টগ্রামে আগমন করে। পর্তুগিজরা প্রথমে জন দ্য সিলভিরার নেতৃত্বে ১৫১৭ সালে এবং পরে আলফন্সো দ্য মিলোর নেতৃত্বে ১৫২৭ সালে চট্টগ্রাম দখলের ব্যর্থ চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত তারা শেরশাহ শূরের বিরুদ্ধে বাংলার সুলতান মাহমুদ শাহকে সাহায্য করার বিনিময়ে তার কাছ থেকে চট্টগ্রাম ও সাতগাঁওয়েরও অধিকার লাভ করে। পর্তুগিজদের অধীনে চট্টগ্রামের সমৃদ্ধি ঘটে এবং একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়ে ‘পোর্টো গ্র্যান্ডে’ (‘porto grande’) বা বিশাল বন্দর নামে পরিচিত হয়। পক্ষান্তরে সাতগাঁও বন্দরের নামকরণ হয় ‘পোর্টো পেকুইনে’ (porto pequene)। ১৬৬৫-৬৬ সালে বাংলার মুগল সুবাহদার শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম অভিযান করে অতর্কিত আক্রমণে বন্দরটি দখল করে নেন। এ সময়ের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬৫১ সালে হুগলিতে তাদের প্রথম কুঠি প্রতিষ্ঠা করে। তবে দীর্ঘকাল তা নিছক বণিকের অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না। কোম্পানি একটি সুরক্ষিত ঘাটি গড়ে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু সে ঘাঁটি কোথায় হবে সেটাই ছিল প্রশ্ন। উইলসন লিখেছেন, শিল্প-বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর জন্য হুগলিই ছিল প্রকৃষ্ট স্থান, আর সামরিক উচ্চাভিলাষ উদ্বুদ্ধ করেছিল বলপূর্বক গুরুত্বপূর্ণ মুগল নগরী চট্টগ্রাম দখলে। কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স ঘন ঘন পরামর্শ দিচ্ছিলেন এবং ১৬৮৫ সালে অ্যাডমিরাল নিকলসনের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডে একটি অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। নিকলসনের প্রতি নির্দেশ ছিল চট্টগ্রাম দখল করে ইংরেজদের জন্য এটিকে সুরক্ষিত করার। এ অভিযান কখনই চট্টগ্রাম পৌঁছায়নি। কিন্তু লন্ডনে কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স তাদের এ মত কখনই পাল্টায় নি যে, চট্টগ্রাম দখল করতে পারলে উপসাগরে তাদের সব রকমের সুবিধা এসে যাবে। ১৬৮৯ সালের জানুয়ারি মাসে কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স চট্টগ্রাম দখলের জন্য ক্যাপ্টেন হিথের নেতৃত্বে একটি নৌবহর প্রেরণ করে। তাদের এ দ্বিতীয় প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। হিথ চট্টগ্রাম দখলের অসুবিধাগুলি উপলব্ধি করেন এবং প্রায় এক মাসকাল সেখানে নোঙ্গর করে থাকার পর উদ্যোগটি পরিত্যক্ত হয়। এ প্রত্যাগমন একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। চট্টগ্রাম আরও একশ বছর বাংলার মুগল শাসকদের অধীনে থাকে। ইতোমধ্যে ইংরেজগণ মুগল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর নিকট তাদের পূর্ব শত্র“তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করায় ১৬৯০ সালে তাদের বাণিজ্যিক সুবিধার নবায়ন মঞ্জুর করা হয় এবং ১৬৯৮ সালে সুতানটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর গ্রাম তিনটির জমিদারি অধিকার প্রদান করা হয়। এর পর থেকেই কলকাতা ধীরে ধীরে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ঝোপঝাড় পরিবেষ্টিত নিচু ধানীজমি থেকে বিশাল বাণিজ্যকেন্দ্র এবং পূর্বাঞ্চলে একটি সাম্রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত হয়। এটা লক্ষণীয় যে, দু শতকের বেশিরভাগ সময় ধরে মুগল, পর্তুগিজ ও ইংরেজগণ ভারত সাগরের নৌবাণিজ্যের প্রধান বন্দর চট্টগ্রামকে নিজেদের আয়ত্তে আনার জন্য লোভাতুর হয়ে উঠেছিল। চট্টগ্রাম দখল করে সেখানে বসতি স্থাপনে ব্যর্থ হওয়ার ফলেই ইংরেজরা শেষ পর্যন্ত কলকাতায় ঘাঁটি স্থাপন করে। পরিকল্পনা বা লক্ষ্য নয়, প্রয়োাজনীয় তাই ইংরেজদের কলকাতায় ঘাঁটি স্থাপন করতে বাধ্য করে। কলকাতায় ইংরেজ ঘাঁটি স্থাপন চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ করে দেয়। আঠারো ও ঊনিশ শতকে কলকাতা ক্রমান্বয়ে বাংলার প্রধান বন্দরে উন্নীত হয় এবং চট্টগ্রাম একটি উপবন্দর (feeder port) হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে নেমে আসে। চট্টগ্রাম বন্দরের এ গুরুত্ব হ্রাস এবং এখানে বন্দর সুবিধার অনুপস্থিতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং ১৮৮৮ সালে চিটাগাং পোর্ট ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য প্রশাসনিক এবং নীতি নির্ধারণী ব্যবস্থা প্রণয়নের প্রথম প্রচেষ্টা ১৮৮৭ সালে গৃহীত হয় এবং ওই বছরই চিটাগাং পোর্ট কমিশনার্স অ্যাক্ট-এর অধীনে একটি পোর্ট ট্রাস্ট গঠন করা হয়। ১৮৮৭ সালে যেনতেন ভাবে ট্রাস্টের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর বন্দরের কার্যাবলি ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলা সরকারের ১৮৮৮ সালের ১৫ মে তারিখের ৩৫ ও ৩৬ নম্বর বিজ্ঞপ্তির দ্বারা বৈধভাবে পোর্ট ট্রাস্ট গঠিত হয়। ১৮৮৭ সালের চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনারস অ্যাক্টে নয় জন কমিশনারের বিধান রাখা হয়। এদের মধ্যে ছয়জন স্থানীয় সরকার কর্তৃক মনোনীত হবেন এবং তিনজন নির্বাচিত হবেন গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের পূর্ব অনুমোদন অনুসারে বাংলা সরকারের মনোনীত স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচক মন্ডলীর দ্বারা। কমিশনারদের কার্যকালের মেয়াদ দুবছর। মনোনীত ছয়জন সদস্যের সকলেই ছিলেন ইউরোপীয়। নির্বাচিত তিন সদস্য ছিলেন ভারতীয়। কালক্রমে বোর্ড গঠনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে এবং অংশত এর কারণ ছিল মনোনীত সদস্যের সংখ্যা বৃদ্ধি। কিন্তু প্রশ্নাতীতভাবেই ইউরোপীয়দের প্রাধান্য অব্যাহত থাকে এবং সরকার কর্তৃক মনোনীত নির্বাচকমন্ডলীতে পরিবর্তনের ফলে এ প্রাধান্য আরও জোরদার হয়। ১৮৮৭ সালের চিটাগাং পোর্ট কমিশনার্স অ্যাক্ট কমিশনারদের সীমিত ক্ষমতা প্রদান করে এবং পোর্ট ট্রাস্টকে ভারত সরকার ও বাংলা সরকারের দ্বৈত প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত করে। কমিশনারদের সকল কার্যক্রম এবং কার্যপ্রণালী স্থানীয় সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষ ছিল এবং স্থানীয় সরকার কমিশনারদের যে কোনো কাজ বা কার্যবিবরণী বাতিল, স্থগিত বা সংশোধন করতে পারত। ১৯০৩ সালে জেটিগুলির নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসন আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তখন থেকে পোর্ট ট্রাস্ট ও রেলওয়ে কোম্পানির মধ্যে কর্তৃত্বের বিভাজন প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি করে। পোর্ট ট্রাস্টের দায়িত্ব ছিল নদী সংরক্ষণ ও জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং রেলওয়ে কোম্পানির দায়িত্বে ছিল সমুদ্রগামী জাহাজের জেটিসমূহ ও উপকূলীয় সুযোগ সুবিধা। পোর্ট ট্রাস্ট বোর্ডে বহু সংখ্যক সদস্যের উপস্থিতিতে এর প্রশাসন চরমভাবে বিঘিত হয়, এরা কেউ এর কাজে যথেষ্ট সময় ও মনোযোগ দেয় নি। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন পোর্ট ট্রাস্ট পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত পোর্ট কমিশনারদের চেয়ারম্যান। তার বহুমুখী কর্ম ব্যস্ততার কারণে পোর্টের দৈনন্দিন প্রশাসনের দায়িত্ব অন্য কারও উপর ন্যস্ত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৮৮৮ সালে পোর্ট ট্রাস্ট গঠিত হবার আগে একজন কর্মকর্তা চট্টগ্রাম বন্দরের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন যিনি একাধারে ছিলেন কাস্টম কালেক্টর ও পোর্ট অফিসার। পোর্ট রেলওয়ে ও পোর্ট কমিশনার্সের দ্বৈত প্রশাসনের জন্য ১৯৬০ সালে জারিকৃত এক অধ্যাদেশ দ্বারা সংশোধিত ১৯১৪ সালের পোর্ট অ্যাক্টের বিধান অনুযায়ী ১৯৬০ সালের ১ জুলাই একটি আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে পোর্ট ট্রাস্ট পুনর্গঠিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বন্দরের ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। বন্দরের দ্রুত উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ জারি করে এবং পোর্ট ট্রাস্ট ভেঙ্গে দেয়। তখন থেকে বন্দরের ব্যবস্থাপনা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনে আসে। লেখক:লায়ন অধ্যক্ষ ডা. বরুণ কুমার আচার্য বলাই প্রাবন্ধিক, bkcharjee1@gmail.com