বছরের প্রায় সাত মাস পানি, আর পাঁচ মাস দিগন্তজোড়া সবুজে ঘেরা মাঠ। পানিতে থাকা মাছ আর খেতে থাকা ধান, এই দুই সম্পদ কেন্দ্র করে চলে হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকা। কখনো পানির ঢেউ বয়ে চলে, কখনো বোরো ধান বাতাসে দোল খায় হাওরের কোলে। বৈচিত্র্যময় চরিত্রে হাওর পাড়ের মানুষের জীবন যাত্রা।
তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। প্রকৃতিতে বর্ষা শুরু হলেও মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরে পানির দেখা নেই। পানিশূন্য বিস্তীর্ণ হাওর যেনো খাঁ খাঁ করছে চারিদিক। তবে গেলো কয়েকদিনের বৃষ্টিতে আশায় বুক বাঁধছেন হাওরের পাড়ের মানুষ। তারা বলছেন, এই বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে হাওর পাবে তার বর্ষার চেনা রূপ।
কাউয়াদীঘি হাওর। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার দু’টি ইউনিয়ন এবং রাজনগর উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। জেলার অন্যতম মিঠাপানির এই হাওরে বর্ষাকালে পানির স্তর ১০ থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত ওঠে। কিন্তু এবারের বর্ষায় পানিশূন্য এ হাওরের বুক।
উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরপারের রসুলপুর, জগৎপুর ও রাজনগর উপজেলার অন্তেহরী এলাকায় দেখা গেছে, হাওরপারের বিভিন্ন গ্রাম থেকে হাওরের পানি এখনো তিন-চার কিলোমিটার দূরত্বে বহমান। কয়েকটি ছোট নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে হাওরে নেমেছেন জেলেরা। কেউ জালের ফাঁদ পাতছেন। কেউ ফাঁদ তুলে মাছ ধরছেন। তবে মাছের তেমন দেখা মিলছে না। ফলে এবার জেলেদের মধ্যে মাছ ধরার আমেজও ছিলো অনুপস্থিত।
এসময় দেখা যায়, হাওর, খাল, বিলে যেটুকু পানি আছে, তাও তলানিতে। বিস্তীর্ণ এলাকা এখনো শুকনো। জেলেরা শিকারে বের হয়ে মাছ না পেয়ে ক্লান্ত ভারাক্রান্ত মনে বাড়িতে ফিরছেন। কেউ কেউ গ্রাম্য বাজারের পাশে বেঞ্চে বসে গল্পগুজবে অলস সময় পার করছেন।
হাওরপারের বাসিন্দারা জানান, এখানকার মানুষের কাছে মাছ ধরাই প্রধান জীবিকার উৎস। অধিকাংশ মানুষই কোনো না কোনোভাবে হাওরের ওপর নির্ভরশীল। আশ্বিন-কার্তিক মাস পর্যন্ত হাওরে পানি থাকে। কিন্তু এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়েছে। ভাসান জলের পরিবর্তে হাওরের বুক শুকনোই ছিলো এতদিন। আশ্বিন ও শ্রাবণ মাসে কয়েকদিনের বৃষ্টিতে হাওরের নিচু এলাকায় অল্প পানি জমছে। একটু একটু করে হাওরে পানি বাড়লেও হাওর তার চিরচেনা রূপে ফিরছে না।
রাজনগর উপজেলার অন্তেহরি গ্রামের মৎস্যজীবী সুবোধচন্দ্র মালাকার বলেন, আমার জমিজমা নেই। মাছ ধরে সংসারের খরচা চালাই। এইবার হাওরে পানি না থাকায় আমার মতো জেলেদের দু’বেলা ভাত খাওয়া কঠিন হচ্ছে। এখন বর্ষা মৌসুম, হাওরে মাছ থাকার কথা। কিন্তু পানিও নাই, মাছও নাই।
হাওরকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে হাঁসের খামার। হাওরে পানি না থাকায় খামারিও বিপাকে আছেন। খামারি রফিক মিয়া বলেন, হাওরে এই সময় পানি থাকে। হাঁস ছেড়ে দিলে হাওর, খালে বিলে ঘুরে শামুক, পোকা, কেঁচো খেয়ে আসত। এতে প্রায় অর্ধেকের উপর খাবারের খরচ কম লাগত। এটা এবার বাড়তি লাগছে।
জানা যায়, কাউয়াদীঘি হাওর বিভিন্ন প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, পাখি এবং বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। বিভিন্ন প্রজাতির মাছে সমৃদ্ধ মিঠাপানির জলাভূমি এই হাওর বুকে। এ হাওরে উদ্ভিদের মধ্যে আছে শাপলা, পদ্ম, কচুরিপানা, হিজল, করচ, তমাল, বনগোলাপ, বরুণসহ ভেষজ নানান জলজ উদ্ভিদ। মাছসহ জলজ প্রাণবৈচিত্র্যের মধ্যে দেশীয় মাছ আছে কই, ছোট খলিশা, শোল, গজার, টাকি, কাইক্কা, গোল ও লম্বা চান্দা, বাইম, পুঁটি, কুঁচিয়া, চিংড়ি, কাঁকড়া, ঝিনুক, শামুক ইত্যাদি।
স্থানীয় পাখির মধ্যে জলমোরগ, সাদাবক, পানকৌড়ি, কানিবক, শামুকখোল, পাতিকুট, ভুতিহাঁস ইত্যাদি। পরিযায়ী পাখির মধ্যে সরালি, গুটিইগল, কুড়াইগল, কাস্তেবক, পানভুলানি, ধূসরবক, বড়বক ইত্যাদির দেখা মেলে এখানে। সরীসৃপের মধ্যে সাপ, কচ্ছপ, শিয়াল, মেছো বিড়াল ইত্যাদি প্রাণীর অভয়ারণ্য।
হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি মৌলভীবাজার সদর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রাজন আহমদ বলেন, ধান ও মাছ এই দুই সম্পদের ওপর ভিত্তি করে হাওরের মানুষের সারাবছরের সংসার খরচ, সন্তানদের লেখাপড়া, চিকিৎসা, আচার-অনুষ্ঠান সবকিছু নির্ভর করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হাওরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এ বছর তীব্র তাপপ্রবাহ ও বৃষ্টিপাত দেরিতে হওয়ায় হাওরে এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত পানির দেখা মিলেনি। এতে মৎস্যজীবীরা চরম বিপাকে।
হাওরাঞ্চলে দেশীয় মাছের প্রজনন ব্যাহতসহ অনেক জলজ উদ্ভিদের অস্তিত্ব সংকটে অনেক প্রানী বৈচিত্র্য বিলীন হয়ে পড়বে বলে তিনি জানান।
ডিবিএন/এসই/ মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পি