চৌগাছা প্রতিনিধিঃ বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। ঋতু বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। কিন্তু দেখা মেলে না আর সেই বর্ষার। যেখানে থাকার কথা ছিলো বর্ষার ভরা মৌসুমে খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর, হাওড়-বাওড় পানিতে থৈ থৈ অবস্থা। সেখানে ঐ সব পানির উৎসগুলো দেখলে মনে হচ্ছে গ্রীষ্মের খরার অবস্থার চেয়েও খারাপ।
এই অবস্থায় চৌগাছার পাট চাষীরা পড়েছে বড় বিপদে। তারা তাদের পাট খুবই অল্প পানিতে পঁচাচ্ছে। অতি নোঙরা ও অল্প পানিতে পাট পঁচানোর ফলে বাংলাদেশে পাট অর্থাৎ সোনালী আঁশের যে চেহারা তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার গুণগত মান। সাথে সাথে কমে যাচ্ছে তার দাম। বিপাকে পড়ছে পাট চাষীরা। অনেক আগের সেই সনাতন পদ্ধতিতেই চলছে পাট জাক দিয়ে পঁচানোর কাজ । ফলে আগের থেকে পাটের গুণগত মান অনেক কমে গেছে, যার কারণে কৃষক পাটের সঠিক দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ।
চৌগাছা বাজারের বিভিন্ন পাটের আড়ৎ ঘুরে দেখা যায়, ভালো গুণগত মানের পাট ১৬০০-১৭০০ টাকা মণ এবং রঙ দূর্বল পাট ১২০০-১৩০০ টাকা মণ দরে বিক্রয় করা হচ্ছে ।
পাট চাষে অন্য সব ফসলের তুলনায় খরচ অনেক কম এবং লাভ অনেক বেশি হবার ফলে এই উপজেলার হাজারো কৃষক পাট চাষে ঝুকে পড়েছে ।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এ বছর উপজেলার সুখপুকুরিয়া, হাকিমপুর, নারায়ণপুর, স্বরুপদাহ, ধুলিয়ানী, সিংহঝুলী, জগীদেশপুর, চৌগাছা, পাতিবিলা, ফুলসারা, পাশাপোল ইউনিয়নসহ পৌর এলাকায় ২ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে তোষা জাতের পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চাষ হয়েছে ১ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমিতে। এ বছর পাটের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৪০ মেট্রিক টন।
আজ রবিবার (২২ সেপ্টেম্বর) উপজেলার ধূলিয়ানী ইউনিয়নের ধুলিয়ানী গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদের পাড়ে পাটের আঁশ ছাড়ানো কয়েকজন শ্রমিকের সাথে কথা হয়। সরেজমিনে দেখা যায় শ্রমিকদের ছাড়ানো আঁশ দেখতে অত্যন্ত নোঙরা ও কালো। তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে অল্প পানিতে সারা গ্রামের লোকে পাট জাক দেয় এইজন্যই নোঙরা পানিতে জাক দেওয়া পাটের রঙ এরকম। তারা আরও বলে প্রতি বছর বর্ষার সময় এই নদীর পানি কানায় কানায় ভরে যায়। কিন্তু এবছর বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের অভাবে প্রচন্ড খরা মৌসুমের মতই অবস্থা।
এ প্রতিবেদকে দেখে কয়েকজন পাট চাষি বলেন, ভাই উপায় নেই, দেখছেন তো কোথাও এক বিন্দু পানি নেই। পাট গুলো শুকিয়ে যাচ্ছে তাই বাধ্য হয়েই এই পানিতেই পাট গুলো জাগ দিচ্ছি।
এ সময় বেশ কয়েকজন পাট চাষি অভিযোগ করে বলেন, এ ভাবে চলতে থাকলে আগামিতে আর পাট চাষ করা হবে না ।
সরকারী কৃষি তথ্য অফিস সূত্রে জানা যায় বিশেষ করে পাট জাক দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি কৃষকদের জানা না থাকায় তারা পাট পঁচানো ও গুণগত মানের আঁশ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আরও জানা যায়, ভালমানের আঁশ উৎপাদনের জন্য পাট গাছে ফুলের কুড়ি আসা মাত্রই পাট কাটতে হবে। কাটার পর চিকন ও মোটা পাট গাছ আলাদা করে আঁটি বেধে পাতা ঝড়িয়ে গাছের গোড়া ৩ থেকে ৪ দিন এক ফুট পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। পরে পরিস্কার পানিতে জাক দিতে হবে।
জাক দেয়ার জন্য খুব গভীর পানির দরকার নেই। মাঠে ঘাসের উপর এক ফুট থেকে দেড় ফুট পানি থাকলে সেখানেও জাক দেয়া যায়। তবে পাট গাছের সংখ্যা বা পরিমাণ অধিক হলে আরও গভীর পানির দরকার হয় যাতে জাক ডুবতে পারে।
মাঠে ঘাস থাকলে পাট গাছগুলো মাটির সংস্পর্শে আসে না, ফলে পাটের রং ভাল থাকে। ঘাস না থাকলে কিছু খড় বিছিয়ে তার উপরও জাক দেয়া যায়। জাকের উপর কচুরী পানা বা খড় বিছিয়ে দিলে খুব ভাল হয়, তবে কখনই সরাসরি মাটি দিয়ে চাপা দেওয়া যাবে না।
জাক দেয়ার পর নিয়মিত গাছ পরীক্ষা করে দেখতে হয় যাতে বেশি পঁচে না যায়। আঁশ মাটিতে বসিয়ে না নিয়ে পানিতে ভাসিয়ে নেয়া ভাল। কেননা তাতে আঁশে মাটি, কাঁকর থাকার সম্ভাবনা কমে যায়। এরপর পরিস্কার পানিতে ধোয়া দরকার।
পানির অভাব দেখা দিলে অথবা জাক দেয়ার জায়গা না থাকলে পাট গাছ না পঁচিয়ে পাট গাছের ছাল পঁচানো যায় এবং এতে পঁচন তাড়াতাড়ি শেষ হয়।
এ জন্য বাঁশের খুটির মাথায় ইংরেজি অক্ষর ইউ এর মত করে কেটে তার মাঝে পাট গাছ রেখে অতি সহজে গাছ থেকে ছাল ছড়ানো সম্ভব।
এরপর চাড়িতে বা চারকোণা গর্ত করে পাটের ছাল জাক দেয়া যায়। পঁচানোর সময় পঁচন পানিতে যদি ছালের ওজনের আনুমানিক ৩৭ কেজি ওজনের জন্য ৫ গ্রাম ইউরিয়া সার মিশিয়ে দেয়া যায় তবে পঁচন আরো তাড়াতাড়ি হয়।
সঠিক পদ্ধতিতে পাট না পঁচানোর জন্য অথবা পঁচন পানির অভাবজনিত কারণে পাট আঁশ ছালযুক্ত ও নীচু মানের হলে পাট আঁশের ওজন প্রতি ৩৭ কেজিতে ৫ গ্রাম ইউরিয়া পানিতে মিশিয়ে আঁশের গোড়ায় ছালযুক্ত স্থানে ছিটিয়ে দিয়ে এক সপ্তাহ পলিথিন বা ছালা দিয়ে ঢেকে রেখে গোড়ার দিকটা পুনরায় ধুয়ে নিলেই আঁশ ছালমুক্ত হয় এবং আঁশের মানও ভাল হয়।
ধোয়া আঁশ কখনই মাটির উপর বিছিয়ে শুকাতে নেই। বাঁশের আড়, রেলিং, ঘরের চাল ইত্যাদিতে বিছিয়ে শুকানো ভাল। মনে রাখতে হবে উন্নতমানের আঁশের দাম সর্বোচ্চ এবং সব সময় এর গ্রাহক থাকে। পক্ষান্তরে নিম্নমানের অতিরিক্ত পঁচানো, কম পঁচানো, রঙ জলা, কালচে, বাকল, কাঠি লেগে থাকা আঁশের বাজার মূল্য সব সময়ই কম হয়ে থাকে।
এই জন্য নিজেরা না জানলে প্রত্যেক চাষীকে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করা উচিত।