বিশ্বজুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে করোনাভাইরাস। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে এরই মধ্যে আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের ২১০টি দেশ ও অঞ্চল। স্থবির হয়ে হয়ে পড়েছে গোটা পৃথিবী। করোনাভাইরাসের প্রকোপে যখন বিপর্যস্ত বিশ্ব তখন প্রকৃতি ফিরছে তার আপন রূপে। ৫০তম ধরিত্রী দিবসের সময়ে সবচেয়ে দূষণমুক্ত সময় পার করছে পৃথিবী।
১৮০টির বেশি দেশে টানা লকডাউন আর কড়াকড়ির ফলে কমেছে দূষণ। বছর বছর সম্মেলন যেখানে ব্যর্থ, ফল হয়নি কোনো আন্দোলনেও, তখন অদৃশ্য এক ভাইরাসের কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কমে গেছে দূষণ। বিশ্বজুড়ে বন্ধ কলকারখানা, চলছে না গাড়ি-বিমান-ট্রেন। ফলে লোকালয়ে দেখা মিলছে নাম না জানা বিরল পাখি আর কীটপতঙ্গের। থাইল্যান্ডের সৈকতে এসেছে দুর্লভ প্রজাতির কচ্ছপ। ভেনিসের স্বচ্ছ হয়ে যাওয়া গ্র্যান্ড ক্যানেলে ফিরতে শুরু করেছে ডলফিন-জেলিফিশ।
পরিবেশ বিষয়ক বিভিন্ন সংস্থার জরিপ বলছে, গেল বছরের তুলনায় দূষণের মাত্রা কমেছে রেকর্ড, প্রায় ৫০ শতাংশ। বায়ুস্তরে কার্বন মনো অক্সাইডের পরিমাণও নেমে এসেছে অর্ধেকে। চাইলেই দূষণ রোধ সম্ভব, সেই বার্তাই যেন দিলো পৃথিবী।
তাই ৫০তম বিশ্ব ধরিত্রী দিবসে দাবি উঠেছে, করোনা বিদায় হলেও প্রতি বছর নিয়ম করে নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য রাখতে হবে লকডাউন।
লকডাউনের জন্য ৩০০ কোটি মানুষ আটকে পড়বার ফলে বিশ্ব অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ বন্ধ।
পৃথিবীতে মোট কার্বন নিঃসরণের এক চতুর্থাংশ ঘটে থাকে পরিবহণের কারণে, তা ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে। সড়ক ও আকাশ পরিবহণ দুইই বন্ধ বহু দেশে। বিভিন্ন শিল্পেও প্রভাব প্রচুর। ভারত, চিন, আমেরিকা, ইতালি, স্পেন, এবং ব্রিটেনে দূষণ নিঃসরণের পরিমাণ ব্যাপক কমেছে, বাতাসের মান বৃদ্ধি ঘটেছে। ভারতের বড় শহরগুলিতে দুষণের মাত্রা কমেছে। নয়া দিল্লি ও মুম্বই তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
চিনে উপগ্রহ চিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, দূষণের মাত্রা সেখানে ব্যাপক কমেছে। বিবিসির এক রিপোর্ট অনুসারেস লকডাউনের ফলে বছরের শুরু তুলনায় সেখানে নিঃসরণের পরিমাণ কমেছে ২৫ শতাংশ, এবং ৩৩৭টি শহরে ভাল মানের বাতাসের অনুপাত বেড়েছে ১১.৪ শতাংশ।
গত বছরের তুলনায় নিউ ইয়র্কে কার্বন মনোঅক্সাইডের পরিমাণ ৫০ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দূষণকারী দেশ বলা হয় চীনকে। প্রতি বছর পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়, তার ৩০ ভাগ একাই করে চীন। তাই মাত্র কয়েক দিনের জন্য হলেও দেশটিতে দূষণের হার কমে যাওয়া অনেক বড় প্রভাব রাখতে যাচ্ছে পৃথিবীর ওপর। সিআরইএর মতে, চীনা শহরগুলোর স্থবিরতার কারণে এই কয়েক দিনের মধ্যেই বাতাসে ২০ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড কম ছড়িয়েছে। যুক্তরাজ্যে এই পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছড়াতে অন্তত অর্ধেক বছর সময় লাগে।
সিআরইএর শীর্ষ বিশেষজ্ঞ লরি মিল্লিভার্টা বলেন, ‘বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে এমন রাতারাতি পরিবর্তন আমার জীবনে দেখিনি।’
তবে, এ প্রসঙ্গে অনেক বিশেষজ্ঞ আরেকটি সতর্কবার্তাও উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে, করোনাভাইরাস মোকাবিলা করতে চীনের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ একদিকে যেমন বাতাসের দূষণ নাটকীয়ভাবে কমিয়ে দিয়েছে, তেমনিভাবে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য আগামী দিনগুলোতে নিশ্চিতভাবেই দেশটি বিপুল উদ্যমে উৎপাদন প্রক্রিয়া চালাবে। এতে আবার বেড়ে যাবে দূষণের মাত্রা। এমনকি এই মাত্রা করোনাভাইরাস পূর্ববর্তী সময়ের চেয়েও বেশি হতে পারে।
পরিবেশবিদ ক্রিসটোস জেফরোস জানান, চাইলেই আমরা পরিবেশ সুন্দর রাখতে পারি- এটাই তার প্রমাণ। তাই প্রতি বছর যদি এভাবে নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য বিশ্বজুড়ে লকডাউন চলে, তাহলে প্রকৃতি আরও সুন্দর হয়ে উঠবে।