পিপলস লিজিং কোম্পানি থেকে আত্মসাৎ করা রিলায়েন্স ফিন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার) ও তার সহযোগীদের ৩ হাজার কোটি টাকা জব্দ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। টাকাগুলো জব্দ করার জন্য বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান।
দুদকের তথ্যমতে, রিলায়েন্স ফিন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় আত্মীয়-স্বজনকে দিয়ে ৩৯টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন পিকে হালদার। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে থাকা ৮৩ জনের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে কৌশলে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি ও তার সহযোগীরা, যা এখন দুদক তদন্ত করছে। এর অংশ হিসেবে আদালতের অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব অর্থ জব্দ করেছে দুদক।
পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীদের ৩ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন কৌশলে আত্মসাৎ করে ওই কোম্পানিকে পথে বসিয়েছেন পিকে হালদার ও তার সহযোগীরা। অর্থ আত্মসাতের বিভিন্ন নথিপত্র পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এবং রিলায়েন্স ফিন্যান্সের এমডির কাছে চিঠি পাঠিয়ে সংগ্রহ করেছেন দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা। এছাড়া অর্থ আত্মসাতে ব্যবহূত বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্যও সংগ্রহ করেছে দুদক। বিএফআইইউ থেকে পিকে হালদার ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাত্সংক্রান্ত নথিপত্র এবং গোয়েন্দা প্রতিবেদনও সংগ্রহ করা হয়েছে। সেসব তথ্যের ভিত্তিতেই আদালতে এসব অর্থ জব্দের আবেদন করে দুদক।
দুদক সূত্র জানায়, পিকে হালদার পিপলস লিজিং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) দায়িত্ব পালন করে প্রায় ৩ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করেছেন। ২শ’ ৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। মামলার এজাহারে পিকে হালদার ও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক ১ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকার লেনদেনের বিষয়ে তথ্য রয়েছে।
সূত্রটি আরও জানায়, কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, কর ফাঁকির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছেন পিকে হালদার। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে দুদক বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করার জন্য অনুরোধ করে। এর ধারাবাহিকতায় পিকে হালদারের অর্থ লেনদেন নিয়ে এক বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, পিকে হালদার ও তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা হয় প্রায় ১ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা, পিকে হালদারের হিসাবে ২৪০ কোটি টাকা এবং তার মা লীলাবতী হালদারের হিসাবে জমা হয় ১৬০ কোটি টাকা। তবে এসব হিসাবে এখন জমা আছে মাত্র ১০ কোটি টাকার কম। এছাড়া পিকে হালদার এক ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকেই ২ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ নিয়েছেন। এসব টাকা দিয়েই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা কেনা হয়। তবে ঋণ নেয়া অর্থের কোনো হদিস নেই।
পিকে হালদার এখন পর্যন্ত ৩৯টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন লিজিং প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ বের করে নিয়েছেন বলে প্রমাণ মিলেছে। তার ও তার সহযোগীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেসব প্রতিষ্ঠানের খোঁজ এখন পর্যন্ত দুদক পেয়েছে সেগুলো হচ্ছে—বিআর ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, নিউ টেক এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, আরবি এন্টারপ্রাইজ, আনন কেমিক্যাল, রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড, পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, আর্থস্কোপ লিমিটেড, এমটিবি মেরিন লিমিটেড, কোলাসিন লিমিটেড, এমএসটি ফার্মা অ্যান্ড হেলথ কেয়ার লিমিটেড, ওক্যাইমা লিমিটেড, জিঅ্যান্ডবি এন্টারপ্রাইজ, দ্রিনান অ্যাপারেলস, মুন এন্টারপ্রাইজ, কনিকা এন্টারপ্রাইজ, সিগমা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড, আইমেক্সকো, সুখাদা প্রপার্টিজ লিমিটেড, সন্দ্বীপ করপোরেশন, উইনটেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, পদ্মা ওয়েভিং লিমিটেড, এমওএইচ ফ্যাশন লিমিটেড, এসএ এন্টারপ্রাইজ, শাহাদাত ট্রেডার্স, সাবির ট্রেডার্স, গ্রিনলাইন ডেভেলপমেন্ট, মেসার্স বর্ণ, রহমান কেমিক্যালস লিমিটেড, ক্রসরোড করপোরেশনস লিমিটেড, তামিম অ্যান্ড তালহা ব্রাদার্স লিমিটেড, ডিজাইনস অ্যান্ড সোর্স লিমিটেড, জেডএ অ্যাপারেলস, সুপিরিয়র টেক্সটাইল, নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড, সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড সিমটেক্স টেক্সটাইল লিমিটেড ও এমজে ট্রেডিং।
এসব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বিতরণের বিভিন্ন নথি তলব করে ১২ আগস্ট ইন্টারন্যাশনাল লিজিংকে চিঠি দিয়েছে দুদক। চিঠিতে এ-সংক্রান্ত আর কারো অনুকূলে ঋণ বিতরণ করা হলে সেসব ঋণের গ্রাহকের কেওয়াইসি, ঋণের প্রস্তাব, শাখার ঋণসংক্রান্ত প্রস্তাব, ক্রেডিট কমিটির অনুমোদন, বোর্ড মেমো চাওয়া হয়েছে।
এসব প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেয়ার বিষয়ে সরেজমিনে পরিদর্শন করেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এভিপি আল মামুন সোহাগ ও সিনিয়র ম্যানেজার মো. রাফসান রিয়াদ চৌধুরী। এ দুজনকে ২৫ আগস্ট দুদকে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দিতে চিঠি পাঠিয়েছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা।
এদিকে, দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান অভিযোগটি অনুসন্ধান করছেন। অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় হাল ইন্টারন্যাশনালের তিন পরিচালক ও এমডিসহ ৯ জনকে তলব করে দুদক। তাদেরকে আগামী ১৮ আগস্ট হাজির হতে বলা হয়েছে। আর ১৯ আগস্ট জিজ্ঞাসাবাদে হাজির হতে বলা হয়েছে আরবি এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটর রতন কুমার বিশ্বাস ও রেপ্টাইলস ফার্মের চেয়ারম্যান শিমু রায়কেও।
এর আগে গত ১০ আগস্ট পিকে হালদারসহ ৫ জনকে তলব করা হয়। কিন্তু পিকে হালদার বিদেশে পলাতক রয়েছেন।