একটি শিশু পৃথিবীতে এলেই ওই পরিবারের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু সিয়ামের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে সব আনন্দ নিমিষেই যেন মাটি হয়ে গিয়েছিল তার পরিবারের। কারণ দুই হাত ছাড়াই জন্ম নিয়েছিল সিয়াম।
সেই ছেলেটির সম্বল বলতে দুই পা। তবে আছে অদম্য মনের জোর, সেই সঙ্গে আছে হার-না মানার দৃঢ় মানসিকতা। আর তাই পঙ্গুত্বের কাছে হার মানেনি শারীরিক প্রতিবন্ধী সিয়াম (১২)। পা দিয়ে লিখে এ বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সঙ্গে জিপিএ ৪ দশমিক ৮৩ পয়েন্ট অর্জন করেছে সে।
জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার ডোয়াইল ইউনিয়নের উদনাপাড়া গ্রামের দিনমজুর দম্পতি জিন্নাহ মিয়া-জোসনা বেগমের ছেলে মো. সিয়াম মিয়া। জিন্নাহ-জোসনা দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে সিয়াম ছোট। জন্ম থেকেই তার দুটি হাত নেই। তবে থেমে নেই তার পড়ালেখা ও খেলাধুলা। চলতি বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ডোয়াইল ইউনিয়নের উদনাপাড়া ব্র্যাক শিশু নিকেতন স্কুল থেকে অংশগ্রহণ করে ভালো ফল লাভ করেছে সে।
সিয়ামের পরিবার জানায়, জন্মের পর তার দুটি হাত নেই বলে একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো কোনো কাজ করতে পারে না সিয়াম। তবে লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। ছোটবেলায় ভাইবোনের সঙ্গে স্কুলে গিয়ে বিভিন্ন অক্ষরের ওপর পা দিয়ে ঘষামাজা করতে করতে লেখার অভ্যাসটা শুরু হয়। পরবর্তীতে অভ্যাসের সঙ্গে বাঁ পা দিয়ে লেখার ধারাবাহিকতা শুরু হয়। এ ছাড়া হাত নেই বলে তার কোনো কাজই থেমে থাকেনি। ক্রিকেট খেলা, সাঁতার কাটা, টিউবয়েল চেপে পানি ভরা থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়ার মতো সব কাজ সে পা দিয়ে করে থাকে।
শারীরিক প্রতিবন্ধী সিয়াম বলেন, ‘আমার দুই হাত না থাকলেও তাতে আমার কোনো সমস্যা হয় না। পা দিয়ে লিখতে লিখতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। শুধু তাই না, আমার সব কাজ আমি নিজেই করে থাকি। আমি পড়ালেখা করতে চাই। পড়ালেখা করে সরকারি বড় কর্মকর্তা হতে চাই।’
সিয়ামের বাবা জিন্নাহ মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে সিয়াম জন্ম থেকেই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। তাকে যাতে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, ছেলের স্বপ্ন অনুযায়ী তাকে অফিসার বানাতে পারি সেইজন্য সবার কাছে দোয়া চাই।’
জিন্নাহ মিয়া আরো বলেন, ‘একজন দিনমজুর হিসেবে তিন ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা করাতে গিয়ে কখনও কারোর কাছে হাত পাততে হয়নি। বছর খানেক আগে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সিয়ামের অবস্থা দেখে প্রতিবন্ধী কার্ডের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সে থেকে কিছুটা আর্থিক সুবিধা পেলেও এখন অনেকটা কঠিন অবস্থার মধ্যে পার করতে হচ্ছে। এছাড়া সিয়ামের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পয়ঃনিষ্কাশনের ক্ষেত্রে কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতে পড়তে হয়েছে। দিনমজুর হওয়ায় আর্থিক সংকটের কারণে তার জন্য হাই-কোমডযুক্ত টয়লেটের ব্যবস্থা করতে পারিনি। এক্ষেত্রে সমাজের বিত্তবানদের কাছে সহায়তা চাইব, যাতে ছেলের পয়ঃনিষ্কাশনের সুবিধাজনক একটা ব্যবস্থা করতে পারি।’
সরিষাবাড়ী উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল হালিম বলেন, ‘সিয়াম অন্য শিক্ষার্থীদের মতো বেঞ্চে বসে পরীক্ষা দিতে পারেনি। তার দুই হাত অচল থাকায় সে পা দিয়ে লিখে পরীক্ষা দেয়। সে ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু পরীক্ষা চলার সময় প্রাথমিক শিক্ষা অফিস তার পাশেই ছিল। তার এই ভালো রেজাল্ট প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য অবিস্মরণীয়।’
এ ব্যাপারে সরিষাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুল ইসলাম ইউএনবিকে বলেন, ‘পরীক্ষা চলাকালীন কেন্দ্র পরিদর্শনে সময় আমি যখন সিয়ামের কথা জানতে পারি, তখন বিষয়টি আমাকে অবাক করেছে। সেই সাথে তার পরীক্ষার রেজাল্টও আমাকে মুগ্ধ করেছে। তার পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতা জেনে, তাৎক্ষণিক উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারের জি আর ফান্ড থেকে পাঁচ হাজার টাকার আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়। যেহেতু সিয়াম বড় হচ্ছে এবং পয়ঃনিষ্কাশনের যে সমস্যার কথা বলা হচ্ছে সে বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। তার পড়াশোনার বিষয়ে যেকোনো সমস্যায় সিয়ামের পরিবারের সঙ্গে আছে প্রশাসন।’
সূত্র : এন টি ভি আনলাইন