কামাল উদ্দিন টগর, নওগাঁ জেলা প্রতিনিধিঃ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে তাল গাছ। এই গাছকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন মাহমুদুন নবী বেলাল নামে এক সাংবাদিক। নিজ উদ্যোগে গত ৪ বছরে নওগাঁ ও রাজশাহী জেলায় এক লাখ তাল গাছসহ ২৫ হাজার ফলজ ও ঔষধি গাছ রোপণ করেছেন।
মাহমুদুন নবী বেলাল পেশায় একজন সাংবাদিক। তিনি মোহনা টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি এবং সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক। গত২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে মান্দা ফেরিঘাট থেকে নিয়ামতপুর সড়কের গাবতলী পর্যন্ত রোপণ করা সাড়ে ৫ হাজার গাছ ৩-৪ ফুট উঁচু হয়ে এখন দৃশ্যমান। এই গাছ লাগাইতে গিয়ে তিনি তার পৈতৃক কৃষিজমি বন্ধক রেখেছেন। তবুও তিনি থেমে থাকেননি। তালের আঁটি সংগ্রহ করা সহজ ছিল না। বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে তাল বীজ সংগ্রহ
করতে এতে অনেক শ্রম ও শ্রমিক লেগেছে।
বেলালের গ্রামের বাড়ি মান্দা উপজেলার বৈলশিং পানাতাপা গ্রামে। তাল আঁটি রোপণে তাকে সার্বক্ষণিক মানসিকভাবে সাহস দিয়েছেন তার বাবা স্বাস্থ্য বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইব্রাহিম হোসেন ও বেলালের স্ত্রী মৌসুমী খাতুন। নওগাঁ-রাজশাহীর ৭৫ কিলোমিটার সড়কের দু’ধারে এ মহাযজ্ঞ চালিয়ে যেতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে জানতে চাইলে তিনি টাকার হিসাব প্রকাশে অপারগতা প্রকাশ করেন।
জানা গেছে, মহাদেবপুর রাণীপুকুর গ্রামের এর গহের আলী (১০৭) তাল গাছ রোপন করে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন জাতীয় পরিবেশ পদক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার হাতে ২০০৯ সালে পদক তুলে দিয়েছিলেন। এর পরের বছর মারা যান গহের আলী। সেই ফলবতী তাল গাছগুলো এখন আর নেই। সড়ক প্রশস্ত করতে গিয়ে সব তালগাছ কাটা পড়েছে। গহের আলীর রোপণ করা তাল গাছের শূন্যস্থানে বেলাল আবারও রোপণ করেছেন তালের আঁটি। একদিন গহের আলীর সেই স্থানে তাল গাছগুলো মাথা
উঁচু করে দাঁড়াবে বলে বিশ্বাস বেলালের।
বেলাল বলেন, মানুষের চলার পথে টাকা-পয়সা বড় কথা নয়। মানুষের মধ্যে স্মৃতি হয়ে থাকতে চাই। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গত ৩-৪ বছর জেলার বিভিন্ন স্থানে ও রাস্তার পাশে তাল বীজ রোপণ করেছি। পাশাপাশি নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের নওহাটা মোড় থেকে রানীপুকুর পযর্ন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার রাস্তার দুপাশে বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ, বনজ, ঔষধি ও শোভা বর্ধনকারী ১০ হাজার গাছের চারা রোপণ করেছি। নিয়মিত গাছ পরিচর্যার জন্য ভিমপুর গ্রামের আশরাফুল ইসলাম নামে একজন পাহারাদার রেখেছি। এ ছাড়া নওগাঁ আদালত চত্বরের সামনেও বিভিন্ন প্রজাতির দুই শতাধিক গাছের চারা রোপণ করে নিজেই নিয়মিত পরিচর্যা করছি।
তিনি আরও বলেন, ৩ বছর ধরে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার রাস্তায় ১ লাখ করে তাল বীজ রোপণ করেছি। এ কাজে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তাল বীজ রোপণে ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।
আমার ইচ্ছে এই বর্ষায় নওগাঁ সদর উপজেলার প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ১০টি করে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা বিনা মূল্যে রোপণের জন্য বিতরণ করব। এ লক্ষ্যে প্রায় ৩০ হাজার গাছের চারা প্রস্তুত করা হচ্ছে। এ ছাড়া কৃষি ও বন বিভাগকে তাক লাগিয়ে পাঁচ হাজার তাল গাছের চারা করা হয়েছে। এ ছাড়া সবাইকে কমপক্ষে পাঁচটি করে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রোপণের জন্য আবেদন করছি। সেইসঙ্গে সরকারিভাবে বেশি বেশি গাছের চারা বিতরণের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে জোর দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নওগাঁ বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, বেলালের কাজ সারাদেশে অনন্য নজির হয়ে থাকবে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের নওগাঁ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজেদুর রহমান বলেন, যত বেশি গাছ লাগানো হবে তত বেশি প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় থাকবে। দেশের প্রায় সর্বত্রই তাল গাছসহ বড় বড় গাছের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। এতে করে বজ্রপাতে মানুষের প্রাণহানি বাড়ছে। তাই গাছ লাগান এবং সুস্থ থাকুন।
এমন মহৎ উদ্যোগ নেওয়ায় সাংবাদিক মাহমুদুন নবী বেলালকে সাধুবাদ জানিয়েছেন নওগাঁ সদর আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার নিজাম উদ্দিন জলিল জন, মহাদেবপুর-বদলগাছী আসনের সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিমসহ জেলা ও পুলিশ, প্রশাসনসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। তারা বলেন, এ রকম শ্রম দিয়ে দেশের সেবা করার মতো মানুষের আজ খুবই অভাব।