একটি বিরল ঘটনা দেখা গেল মহাকাশে। চমকে দেওয়ার মতো একটি মৃত্যু-দৃশ্য।
মহাকাশের অতল অন্ধকারে কী ভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় কোনও অ্যাস্টারয়েড বা গ্রহাণু, এ বার তা ধরা পড়ল হাব্ল স্পেস টেলিস্কোপের চোখে। এই প্রথম। দেখা গেল, মৃত্যুপথযাত্রী ওই গ্রহাণুটির শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে তার ‘হা়ড়-মাংস-অস্থি-মজ্জা’। ভেঙে যাচ্ছে তার শরীর, খুব দ্রুত।
মহাকাশে থাকা নাসার টেলিস্কোপ হাব্লের দেখা সেই মৃত্যু-দৃশ্যের খুঁটিনাটি প্রকাশিত হতে চলেছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটার্স’-এ। যার মৃত্যু-দৃশ্য এই প্রথম স্বচক্ষে দেখল হাব্ল, সেই গ্রহাণুটির নাম ‘অ্যাস্টারয়েড ৬৪৭৮ গল্ট’। ভগ্নস্বাস্থ্য সেই গ্রহাণুটি রয়েছে সূর্য থেকে ২১ কোটি ৪০ লক্ষ মাইল বা ৩৪ কোটি ৪০ লক্ষ কিলোমিটার দূরে।
দু’টি লেজের গ্রহাণু সত্যিই খুব বিরল, বলছেন বিজ্ঞানীরা :
গবেষকরা জানিয়েছেন, এই ব্রহ্মাণ্ডে গ্রহাণু ‘গল্ট’ অবশ্য আমাদের খুব একটা কাছেপিঠে নেই। আমরা যাদের বলি ‘নিয়ার-আর্থ অবজেক্ট’ বা ‘নিও’, গল্ট তাদের দলে পড়ে না। এর আদত বাড়ি মঙ্গল আর বৃহস্পতির মধ্যে থাকা অ্যাস্টারয়েড বেল্ট বা গ্রহাণুপুঞ্জে। যে মুলুকে গল্টের মতোই রয়েছে ৮ লক্ষেরও বেশি গ্রহাণু বা অ্যাস্টারয়েড।
গ্রহাণুটির উপর যাঁরা নজর রেখেছিলেন, তাঁদের অন্যতম অনাবাসী ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী কুমার রঙ্গনাথন ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে বলেছেন, ‘‘যে দু’টি লেজ দেখা গিয়েছে গ্রহাণুটির, তার একটি লম্বায় ৫ লক্ষ মাইল বা ৮ লক্ষ কিলোমিটার। চওড়ায় সেটি ৩ হাজার মাইল বা ৪ হাজার ৮০০ কিলোমিটার। যে লেজটি আকারে ছোট, লম্বায় সেটি ১ লক্ষ ২৫ হাজার মাইল বা ২ লক্ষ কিলোমিটার।’’
আড়াই মাইল বা ৪ কিলোমিটার চওড়া গ্রহাণু ‘গল্ট’-এর কথা আমরা প্রথম জানতে পেরেছিলাম আজ থেকে ৩১ বছর আগে। ১৯৮৮ সালে। কিন্তু তখন তাকে আর পাঁচটা সাধারণ গ্রহাণুর মতোই একটা পাথুরে মহাজাগতিক বস্তু হিসেবেই মনে করেছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তার কোনও লেজের কথা তখন জানা যায়নি।
কী ভাবে জানা গেল দু’টি লেজের কথা?
রঙ্গনাথন জানাচ্ছেন, আবিষ্কারের ৩১ বছর পর, এ বছরের ৫ জানুয়ারি প্রথম দেখা যায়, একটি লেজ রয়েছে গ্রহাণু গল্টের। তার অস্তিত্ব প্রথম নজরে পড়েছিল হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে বসানো নাসার টেলিস্কোপ ‘অ্যাস্টারয়েড টেরেস্ট্রিয়াল-ইমপ্যাক্ট লাস্ট অ্যালার্ট সিস্টেম’ বা ‘অ্যাটলাস’-এর। দেখা যায়, সেই লেজটার গায়ে বিস্তর ধুলোবালি। টুকরোটাকরা। পরে হাওয়াইয়েই বসানো আরও একটি টেলিস্কোপ ‘প্যানোরামিক সার্ভে টেলিস্কোপ অ্যান্ড র্যাপিড রেসপন্স সিস্টেম’ বা ‘প্যান-স্টার্স’-এর নজরেও ধরা দেয় সেই লেজটি।
অন্যতম গবেষক রঙ্গনাথনের কথায়, ‘‘তার পর কেটে যায় আরও দু’টি সপ্তাহ। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে হাওয়াইয়ে বসানো ‘কানাডা-ফ্রান্স-হাওয়াই টেলিস্কোপ’ ও স্পেনে বসানো ‘আইজ্যাক নিউটন টেলিস্কোপে’র চোখে ধরা পড়ে গ্রহাণু গল্টের দ্বিতীয় লেজটি। সেই লেজটা অবশ্য তুলনায় ছোট। কোনও গ্রহাণুর মৃত্যু-দৃশ্য দেখাটা সত্যি সত্যিই খুব বিরল ঘটনা। খুব সচরাচর যা হয় না। হলেও, তা হয়তো এক বা দু’বছরে একটি। এও দেখা গিয়েছে, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি জোরে নিজের চার দিকে লাট্টুর মতো পাক খাচ্ছে গ্রহাণুটি। যা এর আগে দেখা যায়নি।’’
এই মৃত্যু-দৃশ্য কী সুযোগ এনে দিল বিজ্ঞানীদের সামনে?
রঙ্গনাথন জানিয়েছেন, এত দিন গ্রহাণুর গঠন, তার মতিগতি জানা ও বোঝার জন্য তাদের মুলুকে যেতে হত। হয় তাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে হত কোনও মহাকাশযানকে বা সেখানে নামতে হত। যেমন ক’দিন আগে গ্রহাণু ‘বেন্নু’র কাছে গিয়েছে নাসার মহাকাশযান ‘ওসিরিস-রেক্স’। কিন্তু গ্রহাণু গল্টকে টেলিস্কোপের চোখে দেখেই জানা গিয়েছে, তার শরীর থেকে কী ধরনের ‘হাড়-মাংস-অস্থি-মজ্জা’ বেরিয়ে সে সব ছড়িয়ে পড়ছে মহাকাশে।
রঙ্গনাথনের কথায়, ‘‘আমরা দেখেছি, দু’টি লেজের মাধ্যমে গ্রহাণুটি থেকে বেরিয়ে আসছে দু’রকমের পদার্থ। একটি আকারে বালির কণার মতো বড়। অন্যটি ময়দার কণার মতো।’’
অন্যতম গবেষক রঙ্গনাথন ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)-এর জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক দেবেন্দ্র ওঝা ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে জানিয়েছেন, গ্রহাণু গল্টকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে সূর্যই। প্রদক্ষিণের সময় সূর্যের কাছাকাছি এসে পড়লেই এই ভাবে তার রোষানলে পড়তে হয় কোনও গ্রহাণুকে। সূর্যের প্রচণ্ড তাপে যখন তেতে-পুড়ে যায় কোনও গ্রহাণুর গা, পিঠ, তখন সেই গ্রহাণুটির যে জায়গাটা সবচেয়ে বেশি গরম হয়ে যায়, সেখান থেকে বেরিয়ে আসে ইনফ্রারেড রেডিয়েশন বা অবলোহিত বিকিরণ। তাপ যখন তখন তা আদতে শক্তিই। শক্তির ধর্ম অনুযায়ী, সেই শক্তি বদলে যায় অন্য শক্তিতে। এ ক্ষেত্রে অবলোহিত বিকিরণের কিছুটা গতিশক্তির জন্ম দেয়। বাকিটা তাপশক্তিই থেকে যায়। বাড়তি গতিশক্তির জন্য গ্রহাণুটির ঘূর্ণনের (স্পিন) গতিবেগ অত্যন্ত বেড়ে যায়। আর উত্তরোত্তর সেই গতিবেগ বাড়িয়ে চলে। তার ফলে গ্রহাণুর শরীরের অংশগুলি বেরিয়ে আসতে চায় গ্রহাণুটি থেকে। পারে না, কারণ গ্রহাণুর নিজস্ব অভিকর্ষ বল তাকে টেনে ধরে রাখে বলে। যখন বেরিয়ে আসতে চাওয়া গ্রহাণুর সেই অংশগুলির গতিবেগ তার নিজস্ব অভিকর্ষ বলকে ছাপিয়ে যায়, তখনই ভাঙচুর শুরু হয়ে যায় গ্রহাণুটির পিঠে। তার শরীরের অংশগুলি গ্রহাণুটিকে ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। সূর্যের টানে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে মহাকাশে। আর তাতেই লেজ গড়ে ওঠে গ্রহাণুর। এটাকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘ইওর্প এফেক্ট’। চার বিজ্ঞানী ইয়ারকোভস্কি (ই), ও’কিফে (ও), রাদঝিয়েভস্কি (আর) এবং পাড্ডাক (পি)-এর নামের আদ্যক্ষর নিয়েই ওই এফেক্টের নামকরণ করা হয়েছে ‘ইওর্প’।
আর কত দিন আয়ু গ্রহাণু গল্টের?
রঙ্গনাথন বলছেন, ‘‘আর ১০ কোটি বছর পরেই প্রায় অথর্ব হয়ে পড়বে গল্ট। আর তখনই বাজবে তার মৃত্যুঘণ্টা।’’
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা