তিমির বনিকঃ দেশে চা উৎপাদনে নতুন রেকর্ড হয়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় দেড় কোটি কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। এর আগে কোনো মাসেই দেশে এত চা উৎপন্ন হয়নি।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম গনমাধ্যমেকে জানিয়েছেন, অনুকূল আবহাওয়া, ভর্তুকি মূলে সার বিতরণ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও চা বোর্ডের নিয়মিত মনিটরিং, বাগান মালিক ও শ্রমিকদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে চা উৎপাদনে এই রেকর্ড হয়েছে।
এছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপে গত আগস্ট মাসে মজুরি নিয়ে চা শ্রমিকরা যে কর্মবিরতির ডাক দিয়েছিলেন, তার সম্মানজনক সমাধান হওয়ায় সেপ্টেম্বরে চা উৎপাদনে রেকর্ড হওয়ার একটি কারণ বলে জানান তিনি। উৎপাদন বাড়ায় রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন আশরাফুল ইসলাম।
বাংলাদেশ চা বোর্ড জানিয়েছে, দেশের ১৬৭টি চা বাগান এবং ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান থেকে দেশে সেপ্টেম্বর মাসে ১ কোটি ৪৭ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি। অতীতের যে কোনো মাসের উৎপাদন রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে এই উৎপাদন। এর আগে মাস ভিত্তিক উৎপাদনের সর্বশেষ রেকর্ড হয়েছিল গত বছরের অক্টোবর মাসে। ওই মাসে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছিল দেশে।
সেপ্টেম্বর মাসে রেকর্ড উৎপাদন চা শিল্পের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক ঘটনা’ উল্লেখ করে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, চলতি আগস্ট মাসে শ্রমিক কর্মবিরতির কারণে উৎপাদন কিছুদিন বন্ধ থাকলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ দিকনির্দেশনায় শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা হয় এবং বাগানের স্বাভাবিক কার্যক্রম দ্রুত শুরু হয়। এছাড়া প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত, সঠিক সময়ে ভর্তুকি মূল্যে সার বিতরণ, চা রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রণোদনা, নিয়মিত বাগান মনিটরিং, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি ও শ্রমকল্যাণ নিশ্চিতকরণের ফলে এ বছর চায়ের উৎপাদন অনেক ভালো। সরকারের নানা উদ্যোগের পাশাপাশি বাগান মালিক, চা ব্যবসায়ী ও চা শ্রমিকদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফলে চা শিল্পের সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
চা বোর্ডের তথ্যে দেখা যায়, সঠিক ব্যবস্থাপনার ফলে চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) দেশের ১৬৭টি বাগান এবং ক্ষুদ্রায়তন চা বাগানে সবমিলিয়ে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ৩০ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। ২০২১ সালে দেশে মোট ৯ লাখ ৬৫ হাজার ৬ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছিল, যা ছিল ২০২০ সালের চেয়ে ১ কোটি ১ লাখ ১১ হাজার কেজি বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক বছরে এত বেশি চা উৎপাদন হয়নি। শুধুমাত্র উত্তরাঞ্চলে সমতলের চা বাগান ও ক্ষুদ্র চা চাষ থেকেই গত বছরে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা জাতীয় উৎপাদনে যুক্ত হয়েছিল; ২০২০ সালে যা ছিল ১ কোটি ৩ লাখ টন।
বর্তমান ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে-এমন আশার কথা শুনিয়ে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, ২০২২ সালে ২০২১ সালের চেয়েও বেশি চা উৎপন্ন হবে দেশে। মহামারি করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতেও উৎপাদন কর্মকাণ্ড অব্যাহত ছিল। এটাই প্রতীয়মান হয় যে, চা শিল্পের সক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। চা বোর্ডের পক্ষ থেকে উত্তরাঞ্চলে চা চাষিদের ‘ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুলের’ মাধ্যমে চা আবাদ বিষয়ে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহ করা হয়। যার ফলে সমতলের চা বাগান ও ক্ষুদ্র চা চাষ থেকে বেশি চা উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।
চা উৎপাদন বাড়লেও রপ্তানিতে ভালো করছে না বাংলাদেশ। একসময় চা ছিল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চা থেকে কাঙ্ক্ষিত বিদেশি মুদ্রা দেশে আসছে না। উল্টো উন্নতমানের চা আমদানি করে প্রচুর বিদেশি মুদ্রা চলে যাচ্ছে।গত ২০২১-২২ অর্থবছরে চা রপ্তানি থেকে ২১ লাখ ৪০ হাজার ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ কম। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে অবশ্য ইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) চা রপ্তানি থেকে ৪ লাখ ৯০ হাজার ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি।
এ প্রসঙ্গে আশরাফুল ইসলাম বলেন, দেশে চা উৎপাদন বাড়ায় এখন বিভিন্ন দেশ কম চা আমদানি করতে হবে। এতে বিদেশি মুদ্রা সাশ্রয় হবে। একইসঙ্গে রপ্তানিও বাড়বে। তবে সত্যি কথা বলতেকি, চা রপ্তানি বাড়াতে হলে আমাদের চায়ের গুণগতমান বাড়াতে হবে। বিদেশে যে মানের চায়ের চাহিদা বেশি, সেই মানের চা উৎপাদন করতে হবে।
উল্লেখ্য, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় দেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৮ কোটি কেজি চা উৎপাদন ছিল সর্বোচ্চ, যা ছাপিয়ে ২০১৯ সালে উৎপাদন ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি হয়। সময় মতো বৃষ্টি না হওয়ায় ২০২০ সালে উৎপাদন কমে ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৯৪ হাজার কেজিতে নেমে আসে। ২০১৯ সালে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৯ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি। দেশের ১৬৭টি চা বাগানের মধ্যে ১৩৬টিই বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে সর্বোচ্চ ৯১টি, হবিগঞ্জে ২৫টি, সিলেটে ১৯টি, চট্টগ্রামে ২১টি, পঞ্চগড়ে ৮টি বাগান, রাঙামাটিতে ২টি এবং ঠাকুরগাঁওয়ে একটি বাগান আছে।