ডিবিএন ডেস্কঃ সাধারণত মানুষের ডায়াবেটিস অনেক কারণেই হতে পারে। সময়ের ব্যবধানে এর কারনগুলোও জানা গেছে। তবে এবার ডায়াবেটিস হওয়ার পেছনে নতুন এক নতুন কারণ আবিষ্কার করেছে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা। মানবদেহে ইন্টেস্টিনাল অ্যালকেলাইন ফসফেটাস (আইএপি) কমে যাওয়ার কারণে ডায়াবেটিস হয় বলে জানিয়েছেন তারা। গত কয়েকদিন আগে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে এক সংবাদ সম্মেলনে এ আবিষ্কারের কথা তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গবেষণার মাধ্যমে ডায়াবেটিসের নতুন যে কারণ আবিষ্কার করা হয়েছে, সেটি হলো আইএপি কমে যাওয়া। আর আইএপি কমে যাওয়া ডায়াবেটিসের অন্যতম প্রধান কারণ। আবিষ্কারের এ বিষয় ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।
বিশ্বে ৪৬ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর মধ্যে বাংলাদেশে রোগীর সংখ্যা ৮৬ লাখেরও বেশি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার মূল কারণ আবিষ্কারের দাবি করেছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সহকারী অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মধু এস মালো ও জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে একদল গবেষক।
প্রধান গবেষক মধু এস মালো জানান, গত ৫ বছরে ৩০-৬০ বছর বয়সি ৫৭৪ জন মানুষের ওপর গবেষণা করে ডায়াবেটিসের এই নতুন কারণ সম্পর্কে জানা গেছে। গবেষণার ফল ইতোমধ্যে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে ছাপা হয়েছে।
কয়েক দশক ধরে অন্যান্য গবেষক প্রতিষ্ঠা করেছেন যে ডায়াবেটিসের প্রত্যক্ষ কারণ হলো টক্সিন নিয়ন্ত্রিত নিম্ন গ্রেডের সিস্টেমিক প্রদাহ। যার ফলে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন ইনসুলিন উৎপাদন ও কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে ডায়াবেটিস হয়।
মধু এস মালো জানান, মানবদেহের অন্ত্রে থাকা মৃত ব্যাকটেরিয়ার কোষ প্রাচীরের অংশ টক্সিন (এন্ডোটক্সিন) হিসেবে কাজ করে। এ টক্সিন সাধারণত মলের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। তবে উচ্চচর্বিযুক্ত খাবার, ফ্রুকটোজ বা অ্যালকোহল টক্সিনকে রক্তে প্রবেশে সহায়তা করে। ফলে নিম্ন গ্রেডের সিস্টেমিক প্রদাহের সৃষ্টি হয়। যার ফলে ডায়াবেটিস হতে পারে। মানবদেহের অন্ত্রে থাকা আইএপি এনজাইম এ টক্সিনকে ধ্বংস করে দেয়। এ এনজাইমের ঘাটতি হলে অন্ত্রে অতিরিক্ত টক্সিন জমা হয়। এ টক্সিন রক্তে ঢুকে সিস্টেমিক প্রদাহ সৃষ্টি করে। এতে একদিকে যেমন ডায়াবেটিস হতে পারে, তেমনি ইসকেমিক হার্ট ডিজিজও হতে পারে। কেননা ইসকেমিক হার্ট ডিজিজেরও অন্যতম কারণ সিস্টেমিক প্রদাহ।
তিনি আরও জানান, যাদের আইএপি লেভেল বেশি, তাদের ঝুঁকি কম। আবার যাদের আইএপি কম, তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি। দেহে আইএপি কম হলে হার্ট ডিজিজও হতে পারে। কোলেস্টেরল বেড়ে যায়।
গবেষণায় দেখা যায়, যাদের শরীরে এ এনজাইম বেশি থাকে, তাদের তুলনায় যাদের কম থাকে তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার হার ১৩ দশমিক ৮ গুণ বেশি। অল্পবয়সীদের যাদের অন্ত্রে এ এনজাইম দ্রুত কমতে থাকে, তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি ৭ দশমিক ৩ গুণ বেশি। যাদের অন্ত্রে এ এনজাইম কম ছিল এবং পরে বেড়েছে, তাদের ডায়াবেটিস হয়নি। এনজাইমটি যাদের অন্ত্রে কম ছিল, তাদের ফাস্টিং সুগার বৃদ্ধির মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ। এনজাইমের মাত্রা বেশি হলে স্থূল ব্যক্তিদের ডায়াবেটিস হয় না। যাদের দেহে এ এনজাইমের পরিমাণ কম, তাদের এনজাইম খাওয়ানো সম্ভব হলে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। বর্তমানে গবেষকরা এনজাইমটি তৈরির চেষ্টা করছেন।
সংবাদ সম্মেলনে ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ডা. একে আজাদ খান জানান, যাদের আইএপি কমে যায়, তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। এই আবিষ্কার থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরাও বড় কাজ করতে সক্ষম। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান কারণই হলো আইএপি লেভেল বেড়ে যাওয়া। এছাড়া মুটিয়ে যাওয়া, শারীরিক অ্যাক্টিভিটি কমে যাওয়া, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্ট হওয়া অন্যতম। দেশে ১৫ শতাংশ ডায়াবেটিস হয় বংশগত (জেনেটিক) কারণে। যেগুলো রোধে আমাদের কিছুই করার নেই। তবে বাকি ৮৫ শতাংশই আইএপি-সংক্রান্ত কারণে হয়।
গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বারডেম, ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক।