চলমান বৈশ্বিক সংকটে সংবাদপত্রের বিভিন্ন প্রতিবেদন পড়ে আমরা সাধারণ মানুষ কয়েকটি ‘শব্দ‘এর সাথে বেশ পরিচিত হয়েছি। যেমন, ‘দেশের অর্থনীতি, রিজার্ভ ফান্ড, রেমিটেন্স, ইত্যাদি। সকল দেশেই সংকট মোকাবেলা করার জন্য সরকারি কোষাগারে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চিত থাকে। এই সঞ্চিত অর্থই ‘রিজার্ভ ফান্ড‘। একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি কতটা শক্তিশালী তা নির্ভর করে ঐ দেশের এই রিজার্ভ ফান্ড এর পরিমাণের উপর। কোন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যত বেশি রিজার্ভ ফান্ড আছে, সে দেশের অর্থনীতি তত বেশি শক্তিশালী। সুতরাং দৈনন্দিন অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অপব্যবহার না করে, সঞ্চয় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস প্রবাসী বাংলাদেশীদের কষ্টের উপার্জিত অর্থ রেমিটেন্স ও রপ্তানী আয়। এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের সেবা খাত ও বৈদেশিক বিনিয়োগ (Foreign Direct Investment) এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা কঠোর পরিশ্রম করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত অর্থ পরিবারের সদস্যদের স্বচ্ছলতার জন্য দেশে পাঠায়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থই ‘রেমিটেন্স‘। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসে রেমিটেন্স থেকে। যদিও প্রবাসী বাংলাদেশিদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় অংশ অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে ভিন্ন পথে চলে যায়, সরকারের হাতছাড়া হয়। যদি প্রবাসীদের পাঠানো পুরো অর্থ বৈধ উপায়ে দেশে আনানোর ব্যবস্থা করা হতো, তবে বাংলাদেশে রেমিটেন্স এর পরিমাণ অনেক বেশি হতো। কিন্তু প্রবাসীরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও জরুরী প্রয়োজনে কষ্টার্জিত অর্থ দ্রুত নিকটজনের কাছে পৌঁছানোর জন্য অবৈধ হুন্ডির মাধ্যম বেছে নেয়।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বর্ননা করছি। আমার বড় মেয়ে কানাডার টরন্টো ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া শেষে চাকুরী করছে। সম্প্রতি সে তার একমাত্র ছোটবোনকে উপহার কেনার জন্য কিছু পরিমাণ মার্কিন ডলার কানাডার রয়েল ব্যাংক অব কানাডা (RBC)‘র মাধ্যমে পাঠিয়েছিল। সেই ডলারের সমমূল্যের বাংলাদেশি টাকা বাংলাদেশের ব্যাংকের একাউন্টে জমা হতে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় লেগেছে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্বের কারনেই হয়তো প্রবাসীরা বাংলাদেশে তার পরিবারের চিকিৎসা ব্যয় বা কোন জরুরি প্রয়োজনে বা তাৎক্ষণিক যে কোন প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাতে বাধ্য হয়েই অবৈধ হুন্ডির মাধ্যম ব্যবহার করেন। কারন হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো অর্থ গ্রাহক তার প্রবাসী নিকটজনের টেলিফোন বার্তা পাওয়ার অল্পক্ষনের মধ্যেই হাতে পেয়ে যায়। সুতরাং বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলার আয় বৃদ্ধির জন্য বৈধ উপায়ে প্রেরিত অর্থের সমমূল্যের বাংলাদেশি মুদ্রা গ্রাহকের নিকট দ্রুততম সময়ে পৌঁছানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
যাই হোক, সরকার দৈনন্দিন অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন জ্বালানি, ঔষধ, শিল্পের কাঁচামাল, দেশে উৎপাদিত হয় না এমন খাদ্য দ্রব্যসহ অসংখ্য প্রয়োজনীয় মালামাল আমদানির জন্য ব্যয় করে। সরকার সর্বদা আমদানি ব্যয় ও রপ্তানী ব্যয় সামঞ্জস্য রাখতে সচেষ্ট থাকে। এই আমদানি ব্যয় যখনই দৈনন্দিন অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার তুলনায় বেশি হয়, তখনই সরকারকে রিজার্ভ ফান্ড থেকে খরচ করতে হয়। আমদানি ব্যয় বাড়লে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলার বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।
সরকার সাধারণতঃ রিজার্ভ ফান্ড থেকে খরচ করতে চায় না। আমদানী ব্যয় কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিলাসবহুল পন্য, অপ্রয়োজনীয় পন্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন প্রকার শর্তারোপ করে থাকে। দেশে উৎপাদিত হয় এমন দ্রব্য আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা বা কঠিন শর্ত আরোপ করা হলে ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে বলে অভিজ্ঞজন মনে করেন।
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে জ্বালানি তেল আমদানিতে সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকটে বিশ্ব বাজারে জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সংকট মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। কষ্ট হলেও, সাধারণ মানুষ বাস্তবতার নিরিখে সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। সরকারি গাড়ী ক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকারী কর্মকর্তাদের জরুরি সভা ভার্চুয়ালি করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ফলে একটি বড় আকারের ডলার সাশ্রয় হবে। তবে সরকারি গাড়িতে যথেচ্ছ জ্বালানি ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন। সরকারি জ্বালানি তেলের বিভিন্ন ধরনের অপব্যবহার রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়, কর্মকর্তা অফিসে থাকাকালীন সময়ে সরকারি পরিবহনের সরকারি চালকগণ ডলার ব্যয়ে উচ্চমূল্যে আমদানিকৃত জ্বালানি ব্যবহার করে এয়ানকন্ডিশন চালু করে বিশ্রাম নিতে থাকেন। ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ীতে এরকম দেখা যায় না। কারন সরকারী পরিবহনের জ্বালানি সরবরাহ করা হয় স্লিপ এর মাধ্যমে। বিল পরিশোধ করা হয় সরকারী তহবিল থেকে। অপরদিকে ব্যাক্তিগত গাড়ীর জ্বালানি ক্রয় করতে মালিকের পকেট থেকে ক্যাশ টাকা ব্যয় করতে হয়।
দৈনন্দিন জীবনের জরুরি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকারকে বাধ্য হয়ে বর্ধিত মূল্যেই জ্বালানি আমদানি করতে হয়। নিয়মিত অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় এই বর্ধিত মূল্য পরিশোধ করতে অপারগ হইলে সরকার রিজার্ভ ফান্ড থেকে খরচ করতে বাধ্য হয়। রিজার্ভ ফান্ড কমলে দেশের অর্থনীতির ভিত্তি দুর্বল হবে। সাধারণত দুর্যোগকালীন সময় যখন বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস সংকুচিত হয়, তখন সংকট মোকাবেলায় সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আমদানি করতে রিজার্ভ ফান্ড ব্যবহার করে।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২০৯ কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার (২.১ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। চলতি আগস্টের প্রথম সাত দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৫৫ কোটি ডলারের। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৯৫ টাকা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ পাঁচ হাজার ২২৫ কোটি টাকা। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৮ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি। রেমিটেন্সের এই ধারাবাহিকতায় প্রমাণ হয় যে, বৈশ্বিক সংকট থাকলেও রেমিটেন্সের প্রবাহে ব্যাত্যয় ঘটেনি। কিন্তু বৈশ্বিক সংকটে জ্বালানী তেল আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্ভূত অতিরিক্ত ব্যয় মোকাবেলায় সরকার যেমনি সরকারি বিদেশ ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, ঠিক তেমনি বেসরকারি ও ব্যাক্তিগত ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর পরিহার করা প্রয়োজন। কারন আমরা বেসরকারি বা ব্যাক্তিগত সফরে বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলার ব্যয় করি। আমরা বিদেশ ভ্রমনে প্রয়োজনীয় ডলার যেভাবেই সংগ্রহ করি না কেন, সব বৈদেশিক মুদ্রা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই সরবরাহ করা হয়, যা রেমিটেন্স ও রপ্তানী আয় ও অন্যান্য উপায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা হয়। আমরা যদি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বিদেশ ভ্রমণ না করি, অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ পরিহার করি তবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলার সাশ্রয় হবে।
এছাড়া বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে বিলাসী দ্রব্যাদি আমদানি করা হয়। আমরা বলতে পারি, আমার ব্যক্তিগত টাকায় আমি আমদানীকৃত বিলাসী দ্রব্যাদি ব্যবহার করবো, তাতে সরকারের কি। কিন্তু এই বিলাসী দ্রব্যাদি আমদানি করতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকেই বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। সুতরাং আমরা যদি আমদানীকৃত দ্রব্যের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার পরিহার করি এবং বিদেশি পণ্যের পরিবর্তে দেশীয় পণ্য ব্যবহার করি, তবে আমদানিও কমবে, ডলারও সাশ্রয় হবে। ফলে সংকটকালে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে রিজার্ভ ফান্ড থেকে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করা প্রয়োজন হবে না। দেশের অর্থনীতি মজবুত থাকবে।