আপনারা জানেন কি কাদের জন্য কুরবানি করা ওয়াজিব? ‘নিসাব’ পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে প্রাপ্তবয়স্ক ও স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন মুসলিমের পক্ষ থেকে কুরবানি করা ওয়াজিব বা আবশ্যক। অর্থাৎ, কেউ সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা এর সমপরিমাণ নগদ টাকা কিংবা সম্পদের মালিক হলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তার কুরবানি করা আবশ্যক।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছে না এগুলোর গোশত ও রক্ত, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। এভাবেই তিনি সেসবকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর তাকবীর পাঠ করতে পারো, এ জন্য যে তিনি তোমাদের হেদায়াত দান করেছেন, সুতরাং তুমি সৎকর্মশীলদেরকে সুসংবাদ দাও। (সুরা হজ, আয়াত ৩৭)।
অন্যদিকে, হাদিসে এসেছে, মাহনাফ ইবন সুলায়মান (রা.) থেকে বর্ণিত, আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে আরাফায় অবস্থান করছিলাম। তখন তিনি বলেন, হে লোক সকল! আমাদের প্রত্যেক গৃহবাসীর ওপর প্রতি বছর কুরবানি করা ওয়াজিব। (আবু দাউদ, ২৭৭৯)।
কুরবানি কাকে বলে?
কুরবানি শব্দটি হিব্রু কোরবান আর সিরিয়াক ভাষার কুরবানা শব্দদুটির সংগে সম্পর্কিত যার আরবী অর্থ ‘কারো নিকটবর্তী হওয়া’। কুরবানি বা কুরবান অথবা আদ্বহা বা আজহাকে ইসলামি আইন হিসাবে উল্লেখ করা হয়, যা ইদ উল আজহার সময় পশু উৎসর্গের অনুষ্ঠান। ইসলামি মতে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ত্যাগের মনোভাব নিয়ে ১০ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে গৃহপালিত হালাল পশু আল্লাহর নামে উত্সর্গ করাকে কুরবানি বলে।
কুরবানি করার নিয়ম
একটি কুরবানি হলো একটি ছাগল, একটি ভেড়া বা একটি দুম্বা অথবা গরু, মহিষ ও উটের সাত ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ একটি গরু, মহিষ বা উট সাত শরিকে বা সাতজনের পক্ষ থেকে কুরবানি করা যাবে। জাবির (রা.) আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমরা হুদায়বিয়াতে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে সাতজনে একটি উট বা সাতজনে একটি গরু কুরবানি করেছি। (তিরমিজি, হাদিস: ১৫০৮)। এ ক্ষেত্রে কুরবানির পশু যেমন সুস্থ হতে হবে তেমনি কম বয়সী হওয়াও চলবে না।
আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ্ (সা.) এরূপ দুম্বা কুরবানি করতে নির্দেশ দিয়েছেন, যার দুটি শিং হবে নিখুঁত, আর পেট, বক্ষদেশ এবং পা হবে কালো রঙের। অতঃপর এরূপ দুম্বা তার নিকট আনা হলে, তিনি বলেন- হে আয়শা! ছুরি নিয়ে এসো। পরে তিনি বলেন, একে পাথরের ওপর ঘষে ধারালো করো। অবশেষে তিনি ছুরি নেন এবং দুম্বাকে ধরে জমিনে শুইয়ে দেন এবং জবেহ করার সময় নিচের দোয়াটি পাঠ করে দুম্বাকে কুরবানি করেন।
بِسْمِ اللَّهِ اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنْ مُحَمَّدٍ وَآلِ مُحَمَّدٍ وَمِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ
উচ্চারণ : বিসমিল্লাহি আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন মুহাম্মাদিন, ওয়া-আলি মুহাম্মাদিন ওয়া-মিন-আম্মাতি মুহাম্মাদিন।
অর্থ : আমি আল্লাহর নামে শুরু করছি। হে আল্লাহ্! আপনি একে মুহাম্মাদ, আলে মুহাম্মদ এবং উম্মতে মুহাম্মদের পক্ষে কবুল করুন। (আবূ দাউদ, হাদিস: ২৭৮৩)।
এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে জিলহজ মাসে যে ব্যক্তি কুরবানি করতে চান তার জন্য ১০ দিন চুল-নখ কাটায় নিষেধ রয়েছে। উম্মু সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন (জিলহজ মাসের) প্রথম দশ দিন উপস্থিত হয়, আর তোমাদের কেউ কুরবানি করার ইচ্ছা করে, তবে সে যেন তার চুল ও নখের কিছু স্পর্শ (কর্তন) না করে। (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ২৭৮২; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৪৯৫৫)।
কুরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার শর্ত
কুরবানির বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দুইটি শর্ত। যার কোনো একটি না থাকলে কুরবানি হবে না। কেননা কুরবানি কোনো লোক দেখানো ইবাদাতের নাম নয়। বরং এটি শুধু আল্লাহর জন্য। কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা থেকে প্রমাণিত যে, কোনো নেক আমলই আল্লাহ তাআলার কাছে ততক্ষণ পর্যন্ত গৃহীত হয় না; যতক্ষণ পর্যন্ত না তাতে দুটি শর্ত পূরণ হয়। ঠিক এ ক্ষেত্রে কুরবানিও দুই হুকুমের ব্যতিক্রম নয়। শর্ত দুইটি হলো- প্রথমত : কুরবানির জন্য প্রয়োজন ইখলাস তথা একনিষ্ঠতা, দ্বিতীয়ত : কুরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী হওয়া।
একনিষ্ঠতাঃ কুরবানি হবে শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। নিয়তে পরিশুদ্ধতা না থাকলে কুরবানি কবুল হবে না। দুনিয়ায় প্রথম কুরবানি হাবিল ও কাবিলের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে কাবিলের কুরবানি কবুল হয়নি। কাবিলের কুরবানি কবুল না হওয়া প্রসঙ্গে হাবিল বলেছিলেন-‘ আল্লাহ তাআলা মুত্তাক্বিদের (পরহেযগার ও সংযমি) কুরবানিই কবুল করে থাকেন। (সুরা মায়িদা : আয়াত ২৭)।
কুরবানিতে একনিষ্ঠতার প্রয়োজনীয়তা কতবেশি তা কুরআনের বর্ণনা থেকেই সুস্পষ্ট। আল্লাহ তাআলা বলেন-‘আল্লাহর কাছে কখনো ওগুলির (কুরবানির জন্তুর) গোশত পৌঁছে না এবং রক্তও না; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া (সংযমশীলতা); এভাবে তিনি ওগুলিকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এই জন্য যে, তিনি তোমাদেরকে পথ প্রদর্শন করেছেন। আর তুমি সুসংবাদ দাও সৎকর্মশীলদেরকে। (সুরা হজ : আয়াত ৩৭)।
কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ীঃ আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসুলের নির্দেশিত বিধান অনুযায়ীই কুরবানি করতে হবে। এ কুরবানিসহ কোনো ইবাদাতেই তাঁর অংশীদার স্থাপন করা যাবে না। তবেই তাঁর কুরবানিসহ যাবতীয় ইবাদাত কবুল হওয়ার আশা করা যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদাতে কাউকে শরিক না করে। (সুরা কাহফ : আয়াত ১১০)।
আজ ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | হেমন্তকাল | ১৯শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি | বিকাল ৩:৫৭ | বৃহস্পতিবার
ডিবিএন/এসই/ মোস্তাফিজুর রহমান (বাপ্পি)