এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এইচআইভি বিরোধী শক্তিশালী একটি ওষুধ, এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ ভালো কাজ করতে পারে। ঠিকভাবে ব্যবহার করা হলে এই অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল ড্রাগস (এআরভিস) এইচআইভিকে এতোটাই দমিয়ে রাখতে পারে যে, রক্তে এই ভাইরাস শনাক্ত করা অসম্ভব হয়ে যায়। ফলে শারীরিক সম্পর্ক বা ট্রান্সফিউশনের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও কমে যায়। কিন্তু এআরভিস-র কার্যক্ষমতা শুধু এতটুকুই। খবর টাইম ম্যাগাজিনের।যেসব ভাইরাস সক্রিয়ভাবে নিজেদের কপি তৈরি করছে এবং সুস্থ কোষকে আক্রান্ত করছে-সেগুলোর ক্ষেত্রে এ ধরনের ওষুধ ভালো কাজ করে। এইচআইভি বিবর্তন হওয়া শিখেছে ও ওষুধের কার্যকারিতা রোধে নিজেদের পরিবর্তন করতে পারে। লসিকা ও শরীরের অন্যান্য টিস্যুতে লুকিয়ে থেকে, নিষ্ক্রিয় থাকার মাধ্যমে এবং কপি না করে নিজেদের সংরক্ষণ করতে পারে এইচআইভি। যখন রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা কিছুটা ঢিল দেয় তখন আবারও নিজেদের কপি করা শুরু করে এই সুপ্ত ভাইরাসগুলো। এর অর্থ হচ্ছে, কোনো এক ব্যক্তি একবার আক্রান্ত হলে এই ভাইরাসগুলো তাদের শরীরের খোলা গ্রেনেডের মতো রয়ে যায়; পরে লাখ লাখ আক্রান্ত ভাইরাস বছরের পর বছর বা দশকের পর দশক অপেক্ষা করে রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাকে ছাপিয়ে যেতে।এআরভিএস-র চেয়ে এসব ভাইরাস খুঁজে বের করে অপসারণ করা সবচেয়ে ভালো সমাধান। কিন্তু এখনও পর্যন্ত গবেষকরা এমনটা করতে সক্ষম কোনও প্রতিষেধক বা অন্য কিছু তৈরি করতে পারেনি।গত ২ জুলাই ন্যাচার কমিউনিকেশন্সে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, একটি আক্রান্ত প্রাণির জিনোম থেকে এইচআইভি অপসারণ করার নতুন একটি উপায় খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ২৯টি ইঁদুরের ওপর ওই গবেষণা চালিয়ে এমন দাবি করেছেন গবেষকরা। ভাইরাসের সক্রিয়তার মাত্রা কমিয়ে রাখতে কয়েকটি ইঁদুরের ওপর মডিফাইড এআরভি ট্রিটমেন্ট এবং শক্তিশালী জিন-এডিটিং পদ্ধতি ব্যবহার করে আক্রান্ত কোষ থেকে এইচআইভি জিন অপসারণে সক্ষম হয়েছেন তারা। বেশ কয়েকটি টেস্টের পর দেখা গেছে, পরীক্ষা চালানো ৩০ শতাংশ প্রাণির শরীরে এইচআইভির কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।টেম্পল ইউনিভার্সিটির লুইস কাটজ স্কুল অব মেডিসিন অ্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব নেবরাস্কা মেডিকেল সেন্টারের পরিচালক ও এই গবেষণার অন্যতম লেখক কামেল খলিলি বলেছেন, এই পর্যবেক্ষণ আমার জানা মতে প্রথমবারের মতো দেখিয়ে যে এইচআইভি একটি আরোগ্যযোগ্য রোগ।প্রথমে লেজার আর্ট নামের একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মডিফাই করা প্রচলিত এআরভি ওষুধ ব্যবহার করে সক্রিয়ভাবে কপি করতে থাকা ভাইরাসের পরিমাণ কমিয়ে আনেন গবেষকরা। এই গবেষণার আরেক প্রধান লেখক ও ইউনিভার্সিটি অব নেবরাস্কা মেডিকেল সেন্টারের ফার্মাকোলজি অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল নিউরোসায়েন্সের চেয়ারম্যান ড. হাওয়ার্ড জেন্ডেলম্যান এই লেজার আর্ট পদ্ধতির উন্নতি ঘটান।লেজার আর্ট ও প্রচলিত এইচআইভি বিরোধী ওষুধ ব্যবহার করে কপি করতে থাকা ভাইরাসকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছেন গবেষকরা।এইচআইভি বিরোধী ওষুধ যে ভাইরাল জিন-কোষগুলোকে মারতে পারেনি দ্বিতীয় পদ্ধতিতে জিন এডিটিং টুল ক্রিসপার-ক্যাস৯ ব্যবহার করে সেগুলোকে হত্যা করা সম্ভব হয়েছে।খলিলি এর আগে ল্যাবে মানুষ ও প্রাণির কোষ থেকে এইচআইভি জিন সরাতে ক্রিসপার পদ্ধতির সফল ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এইচআইভি ভাইরাস হত্যা করতে ক্রিসপার পদ্ধতি এককভাবে খুব একটা কার্যকর নয়। কেননা যখন এইচআইভি কপি করা শুরু করে তখন ক্রিসপার সব ভাইরাসকে এডিট করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, গবেষকরা ল্যাবে কিছু ইঁদুরকে শুধু ক্রিসপার এবং কিছু ইঁদুরকে লেজার আর্ট পদ্ধতির ট্রিটমেন্ট দিয়েছিল। উভয়পক্ষের ক্ষেত্রেই গবেষণার পাঁচ থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে এইচআইভি ভাইরাস আবার ফেরত এসেছে।কিন্তু যখন লেজার আর্টের সঙ্গে ক্রিসপার পদ্ধতি ব্যবহার করেন গবেষকরা, তখন এসব ইঁদুরের শরীর থেকে এইচআইভি কার্যকরভাবে অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে।খলিলি বলেন, বহু বছর ধরে আমরা এইচআইভিকে একটি সংক্রামক রোগ হিসেবে দেখে এসেছি। কিন্তু যখন এই ভাইরাস একবার কোষের ভেতর প্রবেশ করে, তখন এটি আর সংক্রামক রোগ নয় বরং জেনেটিক রোগে পরিণত হয়। কারণ ভাইরাল জেনোম হোস্ট জেনোমের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়।ফিলাডেলফিয়া ভিত্তিক কোম্পানি এক্সিসন বায়োথেরাপিউটিকসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা খলিলি আরও বলেন, এই রোগ থেকে মুক্তি পেতে, আমাদের একটি জেনেটিক কৌশল দরকার। জিন এডিটিংয়ের মাধ্যমে হোস্ট জিনোমকে কোনো ধরনের আঘাত না করে হোস্ট ক্রোমোজম থেকে ভাইরাল ডিএনএ অপসারণ করা সম্ভব।উল্লেখ্য, গবেষকদের এই টিম ইতোমধ্যে মানুষ ছাড়া বিভিন্ন প্রাণির ওপর এই পরীক্ষা চালিয়েছে এবং একই ধরনের ফলাফল পাওয়ার অপেক্ষা করছে। যদি এমনটা ঘটে, তাহলে এটি মানুষের ওপর এ ধরনের পরীক্ষার দ্বার উন্মোচন করবে। এ বিষয়ে খলিলি বলেন, আমরা যেমনটা প্রত্যাশা করছি-হয়তো ক্রিসপারের মাধ্যমেই এইচআইভি আরোগ্য করা সম্ভব।
সুত্র : আর টি ভি