কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কেন পদত্যাগ করছেন এ নিয়ে সমগ বিশ্বে চলছে আলোচনা ও সমালোচনা। এক দশক আগে কানাডার নির্বাচনে জয়লাভের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হন জাস্টিন ট্রুডো। সুদর্শন এই রাজনীতিবিদ তার বংশীয় রাজনৈতিক মর্যাদা এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বিশ্বব্যাপী আবেদন তুলেছিলেন। এখন তিনি ঘোষণা দিয়েছেন পদত্যাগের। কিন্তু কেন জাস্টিন ট্রুডো পদত্যাগ করছেন?
জানা গেছে, সম্প্রতি তার জনপ্রিয়তা সর্বকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণের মধ্যে অন্যতম হলো- দল থেকে বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিদের প্রস্থান এবং কানাডার জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হঠাৎই উপ-প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডের পদত্যাগের ঘটনাটি ছিল ট্রুডোর জন্য আরেকটি বড় ধাক্কা। তখন ফ্রিল্যান্ড বলেছিলেন, ট্রাম্পের হুমকিকে গুরুত্বসহকারে না নেয়াটা ছিল তার ব্যর্থতা। কানাডায় এমন সময়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা শুরু হলো, যখন কী না দেশটি বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিতে যাওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি দায়িত্ব নিলে কানাডার পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ করবেন।
ট্রাম্পের এই হুমকি কিভাবে মোকাবিলা করা হবে তা নিয়ে অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড এবং মিস্টার ট্রুডোর মধ্যকার মতবিরোধের কারণেই এ পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে।
ফ্রিল্যান্ড সম্প্রতি-ঘোষিত ট্যাক্স হলিডে এবং লাখ লাখ কানাডিয়ানকে চেক পাঠানোর পরিকল্পনাকে “ব্যয়বহুল রাজনৈতিক কৌশল” বলে উল্লেখ করেছেন। ফ্রিল্যান্ড তার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার কিছুক্ষণ আগে, আবাসন মন্ত্রী শন ফ্রেজারও পদত্যাগ করেন।
মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের প্রচেষ্টায় তখন নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা জগমিত সিং জনসমক্ষে ট্রুডোকে পদত্যাগের আহ্বান জানান। কানাডার বামপন্থী নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা সিং বলেন, তারা বারবার মানুষকে হতাশ করেছে। জাস্টিন ট্রুডোর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল জনগণের জন্য কাজ করতে না পারা।
ট্রুডো কীভাবে ক্ষমতায় এলেন?
জাস্টিন ট্রুডো এমন এক সময়ে লিবারেলদের নেতৃত্ব অর্জন করেছিলেন যখন দলে ভয়াবহ দুঃসময় চলছিল। ২০০৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দলটি সাত বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে ছিল এবং প্রথমবারের মতো হাউস অব কমন্সে তাদের অবস্থা নেমে আসে তৃতীয়তে। প্রাক্তন লিবারেল প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোর ছেলে, জাস্টিন ট্রুডো দ্রুত একজন তরুণ এবং ক্যারিশম্যাটিক রাজনীতিবিদ হিসাবে রূপান্তরিত হন।
২০১৫ সালে তার তারুণ্যের চমক এবং আশাব্যঞ্জক রাজনৈতিক বার্তায় প্রভাবিত হন ভোটারেরা। তারা বিপুল সংখ্যক ভোট দিয়ে লিবারেলদের তৃতীয় স্থানের দল থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে পার্লামেন্টে অধিষ্ঠিত করে, যা কানাডার রাজনৈতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন। ট্রুডো যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন বারাক ওবামা, আঙ্গেলা ম্যার্কেল, শিনজো আবে এবং ডেভিড ক্যামেরনের মতো বিশ্বনেতারা শাসনক্ষমতায় ছিলেন। সমসাময়িক এসব নেতা একে একে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেও ট্রুডো তার পদে বহাল থাকেন। ট্রুডো নারীবাদ, পরিবেশবাদ এবং আদিবাসীদের অধিকার এবং তার মন্ত্রিসভায় লিঙ্গ সমতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তার এই উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীই তাকে মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তোলে।
তবে জাস্টিন ট্রুডোর আকাশচুম্বী রাজনৈতিক সুসময় বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। লিঙ্গ সমতা পরে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে যখন তার মন্ত্রিসভার দুইজন নারী মন্ত্রী ২০১৯ সালে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হন।
ট্রুডো কোন কোন সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন?
২০১৬ সালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে জাস্টিন ট্রুডো প্রথম বিতর্কের মুখে পড়েন। তিনি সেসময় তার পারিবারিক বন্ধু আগা খানের ব্যক্তিগত দ্বীপে অবকাশ যাপনের অনুরোধ গ্রহণ করেন। বিমানের টিকিট এবং নানা রকম উপহারও এর অন্তর্গত ছিল।
দ্য কনফ্লিক্ট এবং এথিক্স কমিশনার, মেরি ডসন বলেন, ট্রুডো আগা খানের উপহার গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় নিয়ম ভঙ্গ করেন। কারণ যখন তিনি আগা খানের উপহার গ্রহণ করেছিলেন তখন মি. খানের সঙ্গে সরকারি লেনদেন চলমান ছিল এবং আগা খান ফাউন্ডেশন কানাডায় নিবন্ধিত ছিল। মেরি ডসনের মতে, মিঃ ট্রুডো বা তার পরিবার কর্তৃক গৃহীত ছুটিগুলো এভাবে দেখা যেতে পারে যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ট্রুডোকে প্রভাবিত করার জন্য এই উপহার দেওয়া হয়েছে।
২০১৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনের পূর্বে ট্রুডো তার মুখ এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গে কালো মেক-আপ করে জনসম্মুখে আসেন এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছবি তোলেন ও নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে অংশ নেন। এই কালো মেকআপ করা ছবি ও ভিডিও সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে তিনি স্বীকার করেন যে এ ধরনের আচরণ বর্ণবাদী। তিনি যদিও পরবর্তীতে এ জন্য ক্ষমা চান। সেসময় তিনি বলেছিলেন, প্রসঙ্গ বা পরিস্থিতি যেমনই হোক, কালো মুখের বর্ণবাদী ইতিহাসের কারণে মুখে কালো মেকআপ করা সবসময়ই অগ্রহণযোগ্য।
শিখ কর্মী হরদীপ সিং নিজ্জারের হত্যাকাণ্ডে ভারতের ভূমিকা নিয়ে কানাডায় চলমান তদন্তের কারণে জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে ভারতের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। মিঃ ট্রুডো বলেছিলেন, কানাডার মিঃ নিজার হত্যার সঙ্গে ভারত সরকারের যোগসূত্র রয়েছে এমন বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তার কছে রয়েছে। জবাবে, খালিস্তান আন্দোলনের সমর্থক যাদের ভারত চরমপন্থী মনে করে তাদের প্রতি নরম আচরণ করার জন্য মিঃ ট্রুডোর নিন্দা করেছে।
পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে?
ঘোষণা অনুযায়ী, নিজ দল লিবারেল পার্টি তাদের নতুন নেতা নির্বাচিত না করা পর্যন্ত ট্রুডো প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকবেন। দলীয়ভাবেই নতুন নেতা নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হবে। নতুন নেতা খুঁজতে দলকে সময় দিতে ট্রুডো আগামী মার্চ পর্যন্ত পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত রাখার কথা বলেছেন। এর মানে মে মাসের আগে নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই। পরবর্তী নির্বাচন অবশ্যই অক্টোবরের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হতে হবে। বড় বড় প্রতিশ্রুতি পূরণ না করতে পারা নিয়ে ট্রুডোর প্রতি জনগণের হতাশা আছে। অভিবাসনের মতো বিষয়গুলো সামাল না দিতে পারা নিয়েও তাদের হতাশা আছে।
পেরেজ স্ট্র্যাটেজিসের অধ্যক্ষ এবং লিবারেল স্ট্র্যাটেজিস্ট অ্যান্ড্রু পেরেজ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেছেন, ট্রুডোর যে ব্র্যান্ড তৈরি হয়েছে, তা থেকে নিজেদের দূরে রাখাটা এখন লিবারেলদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হবে।
আজ ২৬শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | শীতকাল | ১০ই রজব, ১৪৪৬ হিজরি | সকাল ৯:১৬ | শুক্রবার
ডিবিএন/এসই/ এমআরবি