তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: “নিরাপদ মাছে ভরবো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে গত ২৩ জুলাই থেকে শুরু হওয়া জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ। কিন্তু মৎস্য সপ্তাহেও ধমে নেই দেশের সর্ববৃহৎ মিঠাপানির মাছের ভাণ্ডারখ্যাত হাকালুকি হাওরে অবৈধ মশারি, কাপড়ি, কারেন্ট ও বেড়জাল দিয়ে পোনা নিধন। মৎস্য অফিসের দায়সারা কার্যক্রম ও মাছের প্রজনন মৌসুমে হাওরাঞ্চলের জেলেদের জীবিকা নির্বাহের বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় মৎস্যজীবিরা হাওর থেকে অবাধে নিষিদ্ধ জাল দিয়ে পোনা মাছ ধরে বিক্রি করছে। মোবাইল কোর্টে জরিমানার কথা মৎস্য অধিদপ্তর বললেও বাস্তবে তা লক্ষ্যণীয় নয়। এতে হাকালুকিতে প্রতিনিয়ত বিলুপ্ত হচ্ছে নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ।
বিভিন্ন সূত্রের বরাতে জানা যায়, প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত বিশাল বিশাল বেড়জাল দিয়ে অবৈধভাবে হাওরের মাছ নিধন করা হচ্ছে। ভোরবেলা থেকে এসকল পোনামাছ যানবাহনে করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে পাচার করা হয়ে থাকে। মৎস্য সপ্তাহ চলাকালে সোমবার দিনদুপুরে হাকালুকি হাওরের জুড়ী উপজেলা অংশে দল বেঁধে অবৈধভাবে জাল দিয়ে মাছ ধরতে দেখা গেছে। তবে সকাল থেকে গভীর রাত অব্দি পোনামাছ নিধন হলেও সংশ্লিষ্ট মৎস্য কর্মকর্তা দেখেও না দেখার ভান করছেন-এমন অভিযোগ অহরহ।
হাওরপারের বাসিন্দাদের অভিযোগ, মৎস্যজীবিরা স্থানীয় মৎস্য অফিসকে ম্যানেজ করে মাছ ধরে বিক্রি করেন। ঢাকাসহ সারা দেশের প্রত্যেক বাজারে নিয়মিত হাকালুকির পোনামাছ বিক্রি হচ্ছে। এ যেনো দেখার কেউ নেই। নিষিদ্ধ বেড়জাল নিয়ে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত আবার ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত পালা করে চলে পোনামাছ শিকার। একেকটি বেড়জালের দৈর্ঘ্য ২০০ থেকে ৫০০ মিটার পর্যন্ত। এ রকম অর্ধশত জাল দিয়ে বিশাল নৌকা যোগে মাছ নিধন করা হচ্ছে। প্রত্যেকটি বেড়জালে ২৫-৩০ জন জেলেকে পোনামাছ শিকারে নামতে দেখা যায়। প্রতিটি জাল দিয়ে ২ থেকে ৩ মণ মাছ শিকার করা হচ্ছে। এ হিসেবে প্রতিদিন এ হাওর থেকে কয়েক টন মাছ শিকার করা হচ্ছে। যার বাজারমূল্য কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা হবে।
জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ চলাকালে হাওরে অবৈধ জালে অবাধে পোনামাছ শিকার চলতে থাকায় জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। হাকালুকি হাওরের অবৈধভাবে আহরিত পোনামাছের সিংহভাগ জুড়ী নাইট চৌমুহনী ও কন্টিনালা নদীর পার থেকে গাড়িযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার হয়। জুড়ী উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে মাত্র কয়েকশো গজ দূরে কন্টিনালা ব্রিজ ও চৌমুহনী। অথচ রহস্যজনক কারণে হাকালুকির পোনামাছ পাচারের বিষয়টি নিয়ে মৎস্য অফিস অনেকটা নিষ্ক্রিয় রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জুড়ী উপজেলা মৎস্য অফিসার আবু ইউসুফ এর আগে জুড়ীতে সহকারী মৎস্য অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছেন। হাওরের মৎস্য নিধন সিন্ডিকেটের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে এখান থেকে তাকে বদলি করা হয়। কিন্তু এবার তিনি এখানে পূর্ণ মৎস্য কর্মকর্তার ক্ষমতা নিয়ে যোগদান করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জেলে জানান, নির্দিষ্ট কয়েকজন সোর্সের মাধ্যমে মৎস্য অফিসার আবু ইউসুফ’কে প্রতিদিন চাঁদাসহ মাছ দিতে হয়। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে মামলার ভয় দেখানো হয়। তাই আমরা বাধ্য হয়েই চাঁদা দিয়ে হাওরে নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ ধরেন।
সম্প্রতি উপজেলা আইন-শৃঙ্ক্ষলা কমিটির মাসিক সভায় তার বিরুদ্ধে জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন অভিযোগ করেন। অবৈধ মাছ শিকারি চক্রের সাথে যোগসাজশ ও বিভিন্ন বিলের ইজারাদারদের সাথে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে সেচ মেশিনে বিল শুকানোর অভিযোগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও হাওরের মাছ রক্ষায় তিনি অনেকটা উদাসীন।
এ ব্যাপারে জুড়ী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবু ইউসুফ জানান, বিশাল হাকালুকি হাওর পাহারা দিয়ে রাখা সম্ভব নয়। রাতের বেলা অসাধুরা অবৈধ জাল নিয়ে হাওরে নামে। এ সময় অভিযানে গেলে তার নিরাপত্তা দিবে কে!
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করার জন্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা রয়েছে। মাছ শিকারিদের বিরুদ্ধে অভিযান না করার বিষয়টি খোঁজ নিয়ে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।