আজ প্রায় ছয় মাস পর ঢাকা থেকে প্রাণের শহর সিরাজগঞ্জের উদ্দেশ্য যাত্রা
শুরু করলাম, সিরাজগঞ্জ বাজার রেল স্টেশনে পৌঁছার দশ মিনিট আগে মাকে ফোন
দিয়ে বললাম..!!
— আর কিছুক্ষণ পর তোমার ছেলে তোমাার কাছে আসছে। মা বলল?
— আসো তাড়াতাড়ি খোকা আমি তোমার জন্যে ভাত বেরে ছিকেতে ঢেকে রেখে দিয়েছি,
এক সাথে খাবো বলে।
— মা বাড়ী পৌঁছাতে এখনো দু-ঘন্টা লাগবে তুমি খেয়ে নাও?
— না খোকা আজ এক সাথে খাবো।
আচ্ছা মা বলে আমি তখন ফোন রেখে দিলাম। কিছুক্ষণ পর ট্রেন স্টেশনে থামল,
হাজারো যাত্রীর ভিরে আমি তাড়াতাড়ি করে নামলাম, আসলে অনেক দিন পর গ্রামের
বাড়ী যাচ্ছি মন টা কেন জানি অনেক আগেই বাড়ীতে চলে গেছে….! রাত্রি এখন
প্রায় দশটা বাজে। স্টেশনে রিক্সা নেই তেমন। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর একটা
রিক্সা পেলাম।
— মামা এই দিকে আসেন?
— জ্বি কোথায় যাবেন?
— যমুনা নদীর ঘাটে।
— যাবো, তবে ১০০ টাকা লাগবে।
আমি মনে মনে ভাবলাম একি ডাকাতের মতো কথা বলছে।
— মামা ২৫ টাকার ভাড়া, ৫০ টাকা।
— গেলে উঠেন না গেলে, স্টেশনে রাত কাটান….
আর কিছু বললাম না, ঐ দিকে আবার মা বসে আছে ভাত বেরে? মা আমাকে কতো কষ্ট
করে বড় করেছে, ছোট থাকতে বাবাকে হারিয়েছি। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মা আর
বিয়ে করেনি…তাইতো মা যা বলে তাই করি, তার কোন কথার অবাধ্য হয়নি কখনো।
তাই রিক্সা চালক মামাকে বললাম চলেন। রিক্সা চলা শুরু করলো।
— আচ্ছা মামা দেখছেন এই শহর টা কেমন নিশ্চুপ-নিস্তব্ধ আকাশে কিরকম বাকা চাদঁ।
— হুম বাবা, এই রকম রাত থাকে বলেই তো রাতও উপার্জনের জন্যে বের হয়।
— মামা যমুনার ঘাটে যেতে আর কয় মিনিট লাগবে।
— আর বেশি সময় লাগবেনা মিনিট দশেক।
ঘাটে পৌঁছে মামাকে ভাড়া দিয়ে দিলাম, আমার গা কেঁপে উঠল। কেমন জানি নদীর
গর্জনটা কেমন অচেনা লাগলো। ঘাটে কোন নৌকা নেই, কোন যাত্রীও নেই শুধু
অন্ধকার। মাঝে মাঝে নদী দিয়ে নৌকা যায়, তার আলো এসে ঘাটটা আলোকিত হয়ে উঠে
তখন খুব ভয় লাগে…
— কেউ আছেন? প্লিজ আসেন আমাকে নৌকা দিয়ে একটু পার করে দিন?
— কোন সারা শব্দ পাওয়া যায় না, তবুও আওয়াজ বের করতে লাগলাম।
আমার তখন চিন্তা হতে লাগলো মাকে ফোন দিতে চাইলাম কিন্তু ভাবলাম মাকে যদি
বলি অহেতুক চিন্তা করবে, তাই বললাম না।
— কিছুক্ষণ পর দেখি একটা নৌকা নিয়ে কয়েকজন লোক এই দিকে আসতেছে, তখন কেমন
জানি প্রশান্তি পেলাম।
নৌকা যখন ঘাটে ঠেকল…
— কেমন জানি নৌকার মধ্যে সব অদ্ভুদ প্রকৃতির সব লোকজন, অনেকের চুল বড়
বড়, তবুও বললাম।
— খুবই বিপদে পড়েছি আমাকে একটু উপারে পার করে দিবেন??
— একজন বলল দেখ আমরা কেবল আসলাম তোকে আবার নিয়ে পার করে দিবে কেমন?
— ভাই আজ ঢাকা থেকে ছয় মাস পর বাড়ী যাচ্ছি, আমাকে একটু পার করে দেন ভাই, প্লিজ?
— ওদের মধ্যে কেমন জানি অদ্ভুদ অদ্ভুদ শব্দ ব্যাবহার করে কি যেন, বলতে
লাগলো…তারপর একজন বলল আচ্ছা নৌকায় উঠে বসো।
আমি নৌকায় উঠে বসলাম এবং ওদের সাথে সুন্দর ভাবে কথা বলতে লাগলাম। এবং
আমার মনের মধ্যে সন্দেহ লাগতেছে এরা তো আমার ব্যাগ কেরে নিবেনা। চরে যে
ডাকাতের বাস, কারর বাড়ীতে ঘটিবাটি রাখেনা। দিনের বেলায় যেমন ধুঁধুঁ চর
রাত্রিতে একদম চারপাশ অন্ধকার।
— একজন বলল, তোমার ভয় করতেছেনা, চেরে যে ডাকাতের উত্তাপ, তোমায় যদি
রাস্তায় কেউ ধরে তোমার ক্ষতি করে?
— আমার কি ক্ষতি করবে আমার কছেতো তেমন কিছুনেই?
— আমি নদীর পানিতে হাত দিলাম, কেমন জানি লাগতেছে হালকা বাতাস শরীর টাকে
নারা দিয়ে যাচ্ছে…
— আচ্ছা আপনারা এই চরে কোথায় গিয়েছিলেন সবাই মিলে? আবার কেনই বা এতো
রাতে ফিরছেন? আমাকে নদী পাড় করে দিচ্ছেন?
— একজন বলে উঠলো আমারা ডাকাত, আর আমি আমার দলের সর্দার?
— আমার সত্যই ভয় পেয়ে গিয়ে বললাম কি?
— আরে ছেলের কান্ড ভয় পেওনা, আরে তোমাকে ভয় দেখানোর জন্যে বললাম।
এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল, ফোনটা পকেট থেকে বের করে দেখি মার ফোন
— বাবা কোথায় এখন?
— আমি এখন নৌকার উপরে মা, তুমি খেয়েছো?
— না বাবা আজ এক সাথে খাবো তোর জন্যে অপেক্ষা করছি।
— মা তুমি খেয়ে নাও, আমার বাড়ী পৌঁছাতে এখনো অনেক দেরি, এই দুর্গম চর
পারি দিতে হবে।
এই বলে ফোনটা কেটে দিলাম এবং আলত করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
— এই যুবক তোমার কাছে এতো ব্যাগ ওর ভিতরে কি?
— তেমন কিছু না, প্রায় ছয় মাস পর বাড়ী ফিরছি তাই মার জন্যে কিছু জিনিস কিনেছি…
এমন সময় দেখি ওরা আবার কি সব অদ্ভুদ শব্দ ব্যাবহার করে যেন কি সব বলছে।
ঘাটে এসে নৌকা পৌঁছল, যমুনার দুর্গম চরে চলা চলের জন্যে তেমন কিছু নেই।
পায়ে হেটে পারি দিতে হয় ১ ঘন্টার পথ। চরে শুধু বালি এবং তার উপরে কৃষকের
ফসল বাদাম। আমি কিছু না দেখে চলতে থাকলাম।
— ওদের মধ্যকার একজন বলল, চলো তোমাকে বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছে দেই?
— আরে লাগবেনা, আপনারা এমনিতেই আমার জন্যে অনেক করেছেন।
— আরে ব্যাগ দাওতো তোমার ভারী হচ্ছে, এই বলে জর করে হাত থেকে নিয়ে চলতে শুরু করল।
ওদের আদর-আপ্পায়ন দেখে ভালো লাগলো।
ফোনের আলোতে হাটতে থাকলাম, আকাশের তারা মিটিমিটি জ্বলছে। যমুনার চরে বাড়ী
ঘর অনেক দূরে দূরে, এখানে ডাকাতের বাস বেশি। একদম বনের কাছে আসতে না
আসতেই পিছন থেকে আমার মাথায় কে যেন আঘাত করল
— আমাকে মারছেন কেন?
— আমরা ডাকাত, তোর কাছে যা কিছু আছে দিয়ে দে?
— আমার কাছে তো এই ব্যাগ ছাড়া কিছু নেই। আর আমি এটা দিতে পারবোনা আমার
জন্যে কিছু জিনিস-পত্র আছে…
— তাইলে তুই দিবিনা। এই বলে মাথায় আরো আঘাত করে বনের মধ্যে ফেলে দিল।
— এই ব্যাগে মনে হয় অনেক কিছু আছে, চল ওকে বনের মধ্যে ফেলে দেই।
— এই বলে বনের মধ্যে ফেলে দিল।
আসলে এই সমাজটা কিছু কিছু মানুষেরর জন্যে বড় অসহায়। তাদের বিবেক বলতে
কিছুনেই। এই নিস্তব্ধ রাতে না ফেরার দেশে চলে যেতে হল। ঐ দিকে মা এখনও
অপেক্ষা করছে তার ছেলের জন্যে। মারা সব সময় ছেলেদের জন্যে অপেক্ষা করে
থাকে। মাদের বোঝা বড় দায়।
লিখা: সাংবাদিক নাসিম আহমেদ রিয়াদ।