মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নের ছয়চিরীতে দিঘীর পাড়ে ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজা বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে শুক্রবার (১৪ এপ্রিল) শুরু হয়েছে। দুইশত বছরের ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজাকে কেন্দ্র করে কমলগঞ্জের ছয়চিরিসহ জেলার আশেপাশের এলাকার মানুষের মধ্যে বিশেষ করে সনাতন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে। ২ দিনব্যাপী এ চড়ক পূজা ও মেলা শেষ হয় শনিবার।
ঐতিহ্যবাহী এই চড়ক উৎসব দেখতে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে হাজার হাজার লোকে লোকারণ্যের ঢল নামে। প্রাচীন ঐতিহ্য লালিত ছয়চিরি দিঘীর পাড়ে বাংলা পুঞ্জিকা মতে প্রতিবছরের চৈত্র সংক্রান্তিতে ২দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে চড়ক পূজা উৎসব। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
জানা যায়, চড়ক পূজা উৎসবের ১০/১২ দিন পূর্ব থেকে বিভিন্ন এলাকার পূজারীর মধ্যে ৪০/৫০ জন সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিব-গৌরী সহ নৃত্যগীত সহকারে ভিক্ষাবৃত্তিতে অংশ নেন। এ ক’দিন তারা পবিত্রতার সহিত সন্যাস ব্রত পালন করে নিরামিষ ভোজি এবং সারাদিন উপবাস পালন করেন। চড়ক পূজার ২ দিন পূর্বে পূজারীরা শ্মশানে গিয়ে পূজা অর্চনা করেন ও শেষে গৌরীর বিয়ে, গৌরী নাচ ও বিভিন্ন গান গেয়ে ঢাকের বাজনায় সরগরম করে গোটা এলাকা জুড়ে। ছয়চিরি দিঘীর পাড়ে ভক্তরা নৃত্য করার জন্য কলাগাছ ও বাঁশের খুটি বেষ্টিত মন্ডলী তৈরী করে। পূজার প্রথম দিন নিশি রাতে তান্ত্রিক মন্ত্র ধারা কাচ পড়া দিয়ে জলন্ত ছাইয়ের উপর মানুষরুপি কালী সেজে নৃত্য করে। অন্য ভক্তগণ নৃত্যের তালে তালে, ছন্দে ছন্দে ঢোলক, কাশি, করতাল বাজিয়ে উৎসব পালন করে।
এসময় দর্শনার্থীরা জয়ধ্বনি এবং নারীদের কন্ঠে হুলু ধ্বনি দিতে থাকেন। জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে এই ‘কালীনাচ’ অত্যন্ত আকর্ষনীয় এবং তান্ত্রিক মন্ত্র দিয়ে ৭টি বলিছেদ (লম্বা দা) এর উপর শিব শয্যা শায়ি হন। শিবের উপর উঠে কালী ভয়ানক এক অদ্ভুত রুপ ধারন করে নৃত্য পরিবেশন করা হয়।
“ডিজিটাল বাংলা নিউজ” অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
এসময় উপস্থিত দর্শনার্থী সবাই আতঙ্কিত হয়ে উঠেন। কালীকাঁচ শেষ হওয়ার পর সকালে পূজারীরা পূজা করে পান বাটা দিয়ে চড়ক গাছকে আমন্ত্রণ জানিয়ে পার্শ্ববর্তী ঐতিহাসিক ছয়চিরি দিঘী থেকে ভেসে উঠে ১০০ ফুট লম্বা চড়ক গাছ। এ গাছের চুড়া থেকে মাচা পর্যন্ত চারটি পাখার মতো করে বাঁধা হয় চারটি মোটা বাঁশ এবং তাতে যুক্ত করা হয় মোটা লম্বা রশি। আগের বছর উৎসব শেষে এই দিঘীতে ডুবিয়ে রাখা হয়ে ছিল চড়ক গাছ। দিঘীর পাড়ে গর্ত খুড়ে সোজা এবং খাড়া করে পোঁতা হয় এই গাছ।
শুক্রবার (১৪ এপ্রিল) দুপুর থেকে নারী পুরুষ দর্শনার্থীর বিশাল সমাগম ঘটে। বিকেল বেলা ভক্ত মন্ডলীতে বিশাল দা (বলিছেদ) দিয়ে নৃত্য, শিবের নৃত্য ও কালীর নৃত্য দেখানো হয়েছে। নৃত্য শেষে ঐতিহাসিক ছয়চিরি দিঘীতে স্নান করে ভক্তদেরকে লোহার শিকড় শরীরের বিভিন্ন অংশে পিষ্ট (গাঁথা) করা হয়। বিশেষ করে জিহবা ও গলায় গেঁথে দেয়া হয়। নৃত্যের তালে তালে চড়ক গাছ ঘুরানো হয়। দেবতার পূজা-অর্চনা শেষে অপরাহ্নে মূল সন্ন্যাসী ৪ জন ভক্তের (জ্যান্ত মানুষের) পিঠে লোহার দু’টি করে বিরাট আকৃতির বড়শি গেঁথে রশিতে বেঁধে ঝুলিয়ে চড়ক গাছ ঘুরানো হয়। এ সময়ে দর্শনার্থীদের অনেকে বাতাসা আর কলা উপরের দিকে উড়িয়ে লুট দেন আর দর্শনার্থীরা তা কুড়িয়ে নেন।
শনিবার (১৫ এপ্রিল) ফেরা চড়ক পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই দিন দেবতার পূজা অর্চনা করা হবে। ঐতিহ্যবাহী ছয়চিরি দিঘীর চার পাড়ের মধ্যে দিঘীর পূর্বপাড়ে ১টি, উত্তর পাড়ে ১টি এবং দক্ষিন পাড়ে ২টি চড়ক গাছ স্থাপন করে পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তান্ত্রিক মন্ত্রের দ্বারা বিভিন্ন অলৌকিক ধর্মীয় কর্মসূচী উপভোগ করার জন্য প্রতি বছরের মত এবারও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে দর্শনার্থীর উপস্থিতি ঘটেছে এবং আশানুরূপ থেকে ও উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত মন্তব্য করেন আয়োজকরা। চড়ক পূজা উপলক্ষে প্রত্যেক বছরের ন্যায় এক বিশাল মেলা। মেলায় গ্রামীণ ঐতিহ্যের বিভিন্ন রকমারী কালেকশনে জিনিসপত্রের নিয়ে বসেছিল দোকানিরা।
চড়ক পূজা ও মেলা পরিচালনা কমিটি প্রতি বছরের মতো এবারও মেলা সুষ্ঠ ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছেন ইতিমধ্যে আয়োজকরা অনেক খুশি। যুগ যুগ ধরে এ চড়ক উৎসব এ অঞ্চলের সনাতনীদের বেশ নাড়া দেয়। বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দু’দিন ও ১লা বৈশাখ বসেছিল মেলা। শেষ চৈত্রের গোধুলীলগ্নে চড়ক গাছ মাটিতে পুঁতে ঘোরানো হয়। এর আগে ভক্ত ও পূজারীরা চড়ক গাছে ফুল, দুধ ও চিনি দিয়ে পূজা দেয়। চড়কপূজা উদযাপন কমিটির নেতা অনিরুদ্ধ প্রসাদ রায় চৌধুরী জানান, ইতিমধ্যে চড়কপূজা অনুষ্ঠানের সব কিছু সম্পন্ন হয়েছে। চড়কপূজা ও মেলা সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার জন্য সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
ডিবিএন/এসডিআর/ মোস্তাফিজ বাপ্পি