চট্টগ্রামে করোনার নতুন স্ট্রেইনের সঙ্গে মিল রয়েছে ছয় দেশের নতুন ভাইরাসের দারুণ সাদৃশ্য রয়েছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এ তথ্য জানিয়েছে। পুরো গবেষণা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জীব বিজ্ঞান অনুষদ ও বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের ল্যাবে সম্পন্ন হয়েছে। বিভাগের সব জেলা থেকে করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করে বড় আকারে এই গবেষণা করা হয়।
গবেষকরা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম বিভাগের সকল জেলা থেকে করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বিভাগের সকল জেলার করোনাভাইরাসের জিনের বিন্যাস উন্মোচন (জিনোম সিকোয়েন্সিং) এর কাজ সম্পন্ন করার পর চট্টগ্রাম বিভাগের ভাইরাসটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, সৌদি আরব, তাইওয়ান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার ভাইরাসের দারুণ সাদৃশ্য পাওয়া গেছে।
তবে প্রত্যেক জেলার ডাটা পৃথকভাবে পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে এর মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা আছে। যেমন চট্টগ্রাম জেলায় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি, চেক রিপাবলিক, সৌদিআরব ও তাইওয়ান; নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী জেলায় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপান; কুমিল্লা ও চাঁদপুরে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, চেক রিপাবলিক, ভারত ও জাপান; ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, সৌদিআরব ও ভারত; কক্সবাজার, রাঙামাটি ও বান্দরবানে যুক্তরাষ্ট্র, সিয়েরা লিওন, জার্মানি, ইটালি, তাইওয়ান ও চেক রিপাবলিক; এবং খাগড়াছড়িতে অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব ও তাইওয়ান এর নমুনার সাথে সাদৃশ্য বেশি লক্ষ্য করা গেছে।
জুলাই থেকে এই গবেষণাকর্ম শুরু হয়। পুরো গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল এবং মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ইমরানুল হক ও ড. এইচ. এম. আবদুল্লাহ আল মাসুদ। এছাড়াও উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মো. খন্দকার রাজিউর রহমান, ইমাম হোসেন, মো. আরিফ হোসাইন ও সজীব রুদ্র, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ছাত্রী শান্তা পাল, এবং বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের ছাত্র মো. ওমর ফারুক সম্পৃক্ত ছিল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া বলেন, এই গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম বিভাগের কোভিড-১৯ (করোনাভাইরাস ডিজিস-১৯) এর উপর সার্বিক চিত্র তুলে ধরা। আর সে লক্ষ্যে আমরা প্রত্যেকটি (১১টি) জেলার প্রত্যেক উপজেলা/থানা থেকে কোভিড পজিটিভ রোগীর নমুনা সংগ্রহ করেছি। তারপর, আরএনএ এর পরিমাণ (কনসেনট্রেশন) ও গুণের (কোয়ালিটি) উপর ভিত্তি করে ৪৬টি নমুনা জিনোম সিকোয়েনসিং এর জন্য নির্বাচন করি। যার মধ্যে ৩৩টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স ৯৯% এর উপরে উন্মোচিত হয়েছে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, বিভাগের ১১ জেলা থেকে সংগ্রহ করা ৩০টি জিনোম বিন্যাস বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করা হয়েছে। এটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। গবেষণায় ১১টি জেলার প্রত্যেক থানা থেকে থেকে করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তারপর ‘আরএনএ’র পরিমাণ ও গুণের ওপর ভিত্তি করে ৪৬টি নমুনা জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়। এর মধ্যে ৩৩টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স ৯৯ শতাংশের ওপরে উন্মোচিত হয়েছে।
গবেষকরা জানান, চট্টগ্রাম বিভাগের প্রায় সব জেলায় আক্রান্তদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইরাসের সদৃশ ভাইরাস পাওয়া গেছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যে মিউটেশনটি সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে সেটি হচ্ছে ডি৬১৪জি। চট্টগ্রাম বিভাগেও এটি সবচেয়ে বেশি আছে। যুক্তরাজ্যে করোনার নতুন স্ট্রেইনের মধ্যে ছয়টি মিউটেশনের একটি পরিবর্তন হচ্ছে ‘পি৬৮১এইচ’। এটি এখানেও পাওয়া গেছে। তবে কোনোভাবেই বলা যাবে না যে এটি যুক্তরাজ্যের সেই ভ্যারিয়েন্ট। কারণ যুক্তরাজ্যের ভাইরাসের ১৭টি মিউটেশন আছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। এর মধ্যে মাত্র একটি মিউটেশন আমরা পেয়েছি।
অধ্যাপক রবিউল হাসান ভূঁইয়া বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় প্রাথমিকভাবে দেখা যাচ্ছে, সব সিকোয়েন্সের বিভিন্ন লোকেশনে মোট ১২৬টি ভিন্ন ভিন্ন মিউটেশন হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি মিউটেশন চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে।’
তিনি আরো জানান, এরই মধ্যে ১২টি নমুনার জিনের বিন্যাস গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডাটাবেজে জমা দেয়া হয়েছে। আমাদের গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম বিভাগের কোভিড-১৯-এর ওপর সার্বিক চিত্র তুলে ধরা। উন্মোচন করা জিনের বিন্যাস চট্টগ্রাম বিভাগের সব জেলায় ভাইরাসের প্রকৃতি, বিস্তার, উৎপত্তিস্থল, বৈচিত্র্য ও মিউটেশনের মাধ্যমে জিনগত পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা দেবে, যেটি ভবিষ্যতে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বড় ভূমিকা রাখবে।