প্রায় ২০ বছরের জোটসঙ্গী বিএনপির সঙ্গে আর থাকছে না জামায়াতে ইসলামী। সম্প্রতি দলটির কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জামায়াতের মাঠ পর্যায়ের নেতাদের দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরায়র সিদ্ধান্তের আলোকে এখন থেকে ২০-দলীয় জোটের কোনো কর্মসূচি ও বৈঠকেও অংশ নেবে না জামায়াত। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
একাদশ সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর জামায়াতের গুরুত্ব অনেকটাই কমে যায়, বিশেষ করে বিএনপির কাছে। ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষনেতা ড. কামাল হোসেন জামায়াতকে কটাক্ষ করে নানা মন্তব্যও করেছেন। এসব বিষয় নিয়ে জামায়াত বিএনপির ওপর ক্ষুব্ধ হয়।
এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই বিএনপির সঙ্গ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াত। বিষয়টি টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। জামায়াতের বিএনপি ছাড়ার নেপথ্য কারণ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে দূরত্ব বা ড. কামাল হোসেনের ভুমিকার কারণে জামায়াত বিএনপি ছাড়ছে প্রচারণা পেলেও এর নেপথ্যে রয়েছে অন্য বিষয়।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেছিল বিএনপি। এর আগে বিএনপির প্রতিনিধিরা ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির উচ্চ পর্যায়ে সম্পৃক্ত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেছিলেন। অতীতে দলটির ভারতবিরোধী ভূমিকা বর্তমানে নেই বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপির ওপর আস্থা রাখতে পারছে না ভারত।
সম্প্রতি গণমাধ্যমের কাছে বিজেপির পলিসি রিসার্চ সেলের সিনিয়র সদস্য অনির্বাণ ড: গাঙ্গুলি বলেছেন, ‘জামাতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কই আসলে এই সমস্যার মূলে। কথাটা হল বিএনপি তাদের ভারতবিরোধী অবস্থান বদলাবে কি বদলাবে না, সেটা কিন্তু গৌণ।’
তিনি বলেন, ‘প্রধান ব্যাপারটা হল জামাতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তারা আগে পরিষ্কার করুক। ওটা নিয়ে তারা লুকোচুরি খেলেই যাচ্ছে! বাকি সবই অন্য কথা। বিএনপি কী ভাবল না ভাবল তাতে ভারতের বিশেষ কিছু যায় আসে না।’
ড: গাঙ্গুলি বলছেন, ‘যে রাজাকারদের বিএনপি আজীবন তোষামোদ করে এসেছে তাদের প্রতি অবস্থান পরিষ্কার না করলে ভারতেরও যে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয়, এটা তো বুঝতে হবে ‘
বিএনপি নেতারা প্রায়ই ভারতের নীতি-নির্ধারকদের উদ্দেশে পরামর্শ দিয়ে থাকেন, বাংলাদেশে তাদের সব ডিম একটাই ঝুড়িতে (অর্থাৎ আওয়ামী লীগ) রাখাটা কোনও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
তার জবাবে অনির্বাণ গাঙ্গুলি কটাক্ষ করে এমন কথাও বলছেন, ‘যারা নিজেদের সব ডিম জামাতের ঝুড়িতে রেখে বসে আছে, তাদের মুখে অন্তত এ ধরনের কথা মানায় না!’
আর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মুচকুন্দ দুবে বলেছে, ‘ভারতের ভেতর বিএনপির হয়ে যারা লবিইং করতে পারেন বলে বিএনপির ধারণা, তাদের সঙ্গে এসে দলের নেতারা দেখাও করছেন। কিন্তু সমস্যা হল, মানুষ তো মুখের কথায় নয় – বরং পুরনো অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই চলে। আমরা কী করে ভুলি খালেদা জিয়ার আমলে দু’দেশের সম্পর্ক একেবারে থমকে গিয়েছিল?’
তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর বদ্ধমূল ধারণা চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিএনপি আমলে যে দশ ট্রাক অস্ত্র পাচার করার চেষ্টা হয়েছিল তাতে আইএসআই তথা পাকিস্তান সরকারে প্রত্যক্ষ যোগসাজস ছিল।’
ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসেকাজ করা নিরাপত্তা বিশ্লেষক শান্তনু মুখার্জির বলছেন, ‘প্রথম সমস্যা হল বিএনপির পাকিস্তানপন্থী ভূমিকা। ভারতের চেয়ে তারা যে পাকিস্তানের অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ, সেটা তো সহজেই বোঝা যায়। তা ছাড়া খালেদা জিয়ার আমলে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলে আসামের আলফা কিংবা মণিপুর-নাগাল্যান্ডের জঙ্গীরাও বাংলাদেশে আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছে বলে ভারতের কাছে প্রমাণ আছে, আর সেটাও ছিল আমাদের জন্য খুবই বিপজ্জনক।’
এসব বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে, বিএনপি যত দিন জামায়াতকে সঙ্গে রাখবে ততদিন ভারত তাদের বিশ্বাস করবে না। যা বিএনপির জন্য রাজনৈতিক মৃত্যুর শামিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির বোধ উদয় হয়েছে। তারা জামায়াতের কারণে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি যে কোনঠাসা হয়েছে পড়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে জামায়াতকে আর সঙ্গে রাখতে চাইছে না। বিষয়টি বুঝতে পেরেই বা বিএনপির পক্ষ থেকে বার্তা পেয়েই জামায়াত সঙ্গ ছাড়ার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।