মোঃ সদরুল কাদির (শাওন)::
যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেখানে ‘গণতান্ত্রিক’ কিংবা ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক’ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। গত এক দশক ধরে স্বৈরতান্ত্রিক ও ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক অবস্থার মাঝামাঝি ‘হাইব্রিড রেজিম’ তালিকায় দেশটি অবস্থান করছে বলে ইআইইউ বলছে।
তবে বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের স্কোর আগের বছরের তুলনায় ০.১৪ বেড়েছে। ফলে ২০১৭ সালে যেখানে দেশটির অবস্থান ছিলো ৯২তম, পরের বছর হয়েছে ৮৮তম। ইআইইউ প্রতিটি দেশকে গণতন্ত্র সূচক পরিমাপ করতে পাঁচটি মানদন্ড ব্যবহার করে। সেগুলো হলো- নির্বাচনী ব্যবস্থা ও বহুদলীয় অবস্থান, নাগরিক অধিকার, সরকারে সক্রিয়তা, রাজনৈতিক এবং অংশগ্রহণ। প্রত্যেকটি মানদন্ডকে ০ থেকে ১০ স্কোরের মধ্যে হিসেব করে গড় করা হয়। প্রাপ্ত স্কোরের ভিত্তিতে দেশগুলোকে চারটি ক্যাটেগরিকে ভাগ করা হয়; স্বৈরতন্ত্র, হাইব্রিড রেজিম, শ্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র এবং পূর্ণ গণতন্ত্র।
ইকোনমিস্টের গণতন্ত্র সূচক অনুযায়ী ক্যাটাগরি ৯-১০ পূর্ণ গণতন্ত্র, ৭-৮ ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, হাইব্রিড রেজিম ৫-৬, স্বৈরতন্ত্র ০-৪
এই হিসেব অনুযায়ী, একটি দেশকে ‘পূর্ণ গণতান্ত্রিক’ অবস্থায় যেতে হলে গণতান্ত্রিক সূচকে ৯ থেকে ১০ স্কোর করতে হয়। যেসব দেশের স্কোর ৭ থেকে ৮ সেসব দেশকে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ বলা হয়েছে। তবে এর নিচের অবস্থান ‘হাইব্রিড রেজিম’-এ তালিকাভুক্ত দেশগুলোর স্কোর ৫ থেকে ৬ এবং ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ দেশগুলোর স্কোর ০ থেকে ৪ এর মধ্যে।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের হিসেব মতে বিশ্বের ১৬৭টি দেশের মধ্যে মাত্র ২০টি দেশ গণতন্ত্রের তালিকায়। ৫৫টি দেশ ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশের তালিকায়। ৩৯টি দেশ হাইব্রিড রেজিমের তালিকায় এবং ৫৩টি দেশ স্বৈরতান্ত্রিক দেশের তালিকায় রয়েছে।
‘হাইব্রিড রেজিম’এর বৈশিষ্ট্য কী?
‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ এবং ‘স্বৈরতন্ত্রের’ মাঝামাঝি অবস্থান ‘হাইব্রিড রেজিম’ আসলে কী? একটি দেশের কোন কোন বৈশিষ্ট্যের জন্য এই তালিকায় পড়ে – ইআইইউ-এর গবেষণা পদ্ধতিতে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেখানে যা বলা হয়েছে তা হলো- নির্বাচনে বেশ অনিয়মের ঘটনা ঘটে, যা নির্বাচনের সুষ্ঠুতা ও নিরপেক্ষতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
বিরোধী দল এবং প্রার্থীর ওপরে সরকারি চাপ খুবই সাধারণ ঘটনা; রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সরকারের সক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের বিষয়ে মারাত্মক দুর্বলতা দেখা যায়, যা ত্রুটিপূর্ণি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকেও বেশি।
দুর্নীতির বিস্তার প্রায়ই সর্বত্র এবং আইনের শাসন খুবই দুর্বল; সিভিল সোসাইটি দুর্বল; সাধারণত, সাংবাদিকরা সেখানে হয়রানি ও চাপের মুখে থাকে এবং বিচার ব্যবস্থাও স্বাধীন নয়।
বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থান ঃ ইকোনমিস্ট ইনটিলিজেন্স ইউনিট-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ৬.১১ (ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র)। সেটি ২০০৬ সালে। কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে দেশটি ‘হাইব্রিড রেজিম’ এর তালিকায় আছে।
২০১৭ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৫.৪৩। ইকোনমিস্ট গ্রুপ ২০০৬ সালে এই সূচক প্রকাশ শুরু করার পর সেটাই ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বাজে অবস্থান। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান কত? ইআইইউ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও শ্রীলঙ্কায় ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ বিরাজ করছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তানে ‘হাইব্রিড রেজিম’ এবং আফগানিস্তানে ‘স্বৈরতন্ত্র’ সরকার ব্যবস্থা আছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
২০০৬ সাল থেকে এধরনের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করছে ইআইইউ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্র পর্যালোচনা করে তারা এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তবে এবার ২০১৮ সালে বিশ্বে গণতন্ত্রের অবস্থায় বয় কোনো হেরফের হয়নি। সর্বোচ্চ স্কোর ৯.৮৭ পেয়ে গণতন্ত্র সূচকে সবচেয়ে উপরের অবস্থানে আছে নরওয়ে। অন্যদিকে মাত্র ১.০৮ স্কোর নিয়ে উত্তর কোরিয়ার অবস্থান সবার নীচে।
গ্রাফিকস এর মাধ্যমে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট যে চিত্র তুলে ধরেছে তা এমন- ভারত গণতন্ত্র সূচকে বৈশ্বিক অবস্থান ৪১তম গড়স্কোর ৭.২৩ পেয়ে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, শ্রীলঙ্কা বৈশ্বিক অবস্থান ৭১তম গড় স্কোর ৬.১৯ পেয়ে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, বাংলাদেশ গণতন্ত্র সূচকে বৈশ্বিক অবস্থান ৮৮তম গড় স্কোর ৫.৫৭ পেয়ে হাইব্রিড রেজিম, ভুটান গণতন্ত্র সূচকে বৈশ্বিক অবস্থান ৯৪তম গড়স্কোর ৫.৩০ হাইব্রিড রেজিম, নেপাল গণতন্ত্র সূচকে বৈশ্বিক অবস্থান ৯৭তম গড়স্কোর ৫.১৮ পেয়ে হাইব্রিড রেজিম, পাকিস্তান গণতন্ত্র সূচকে বৈশ্বিক অবস্থান ১১২তম গতস্কোর ৪.১৭ পেয়ে হাইব্রিড রেজিম ও আফগানিস্তান গণতন্ত্র সূচকে বৈশ্বিক অবস্থান ১৪৩তম গড়স্কোর ২.৯৭ পেয়ে স্বৈরতন্ত্র দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সূত্র: ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট।