রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা ভূমি অফিস দীর্ঘ সময় ধরে ছিলো গঙ্গাচড়া ইউপি ভবনের পাশে একটি টিনসেড বিল্ডিংয়ে। ছোট অফিসের জনবল বসার সংকটের মধ্যে দিয়ে সেবা দিয়ে আসছিলেন সহকারী কমিশনার (এসিল্যান্ড) (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটগণ। ৪ মাস আগে সরকার উপজেলা ভূমি অফিসকে বিশাল জায়গায় নিয়ে আসে। নির্মাণ করা হয় দ্বিতল ভবন। ইউপি ভবনের পাশের অফিস থাকাকালীন সময়ে ২০২২ সালের ৬ নভেম্বর এসিল্যান্ড হিসেবে যোগদান করেন নয়ন কুমার সাহা। ইচ্ছা ছিলো অফিসটা নিজের পরিকল্পনামত সাজিয়ে সেবা দিতে। কিন্তু সেবায় আন্তরিকতা থাকলেও নিজের কি যেন অপূর্ণতা থেকে যেত। নির্মিত নতুন অফিসে কার্যক্রম চালু হলে সেখানে নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেন এসিল্যান্ড নয়ন কুমার সাহা।
“জনসেবার জন্য প্রশাসন, দৃষ্টান্ত হবে দেশের উন্নয়ন” এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে সকল মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে নানা উদ্যোগ গ্রহন করেন। হয়রানি বন্ধে সঠিক সময়ে সঠিক সেবা নিশ্চিতে অফিসের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের নির্দেশনা দেন। এজন্য অফিসের প্রবেশ পথে লিখেছেন ভূমি অফিসে আপনাকে স্বাগতম। প্রবেশের পরেই হেল্প ডেক্স, সেখানে লেখা আছে বলুন আপনাকে কিভাবে সহায়তা করতে পারি? সেবা প্রদানের সুযোগ দানের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এভাবে সেবাপ্রত্যাশীদের সম্মান দিয়ে সেবা প্রদান করেন।
সরকার অনলাইনের মাধ্যমে ভূমির সেবা চালু করলেও অনেক সেবাপ্রত্যাশী সরাসরি অফিসে গিয়ে সেবা নিতে ও পরামর্শ গ্রহন করে। অফিসে সেবা নিতে আসাদের জন্য একটি রেজিষ্টার খাতা খুলেছেন। এ খাতায় তাদের নামসহ কি সেবার জন্য এসেছেন তা লিপিবদ্ধ করেন। সঠিক সময়ে সেবা নিশ্চিতে তিনি এ উদ্যোগ গ্রহন করেন। সেবা প্রত্যাশীদের সেবা সহজ করণে অফিসের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের কার কি সেবা দেওয়ার কাজ তার একটা চার্ট ঝুলিয়েছেন। অনলাইনে আবেদনের ম্যাসেজের মাধ্যমে জানানো হলেও অনেক সেবাপ্রত্যাশী সঠিক সময়ে আসতে না পারলে তিনি নিজেই ফোন করে অফিসে ডেকে নিয়ে তুলে দেন সম্পূর্ণ হওয়া খারিজ খতিয়ানসহ অন্যান্য সেবা সম্পূর্ণ হওয়া কাগজপত্র।
ওয়ারিশ জমি উদ্ধারে তার চেষ্টার কমতি নেই। অফিসের সকল কর্মকান্ডে দালাল ও ঘুষমুক্ত করেছেন। এ সকল দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধে অভিযান বা ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করতে উপজেলার এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে যান। করেন বাজার মনিটরিং। তিনি এ পর্যন্ত ১০৮ টি মামলায় ১৩ লক্ষ ২৭ হাজার টাকা অর্থদন্ড রাষ্টীয় কোষাগারে জমা প্রদান ও ১৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে বিনাশ্রম কারাদন্ড দিয়েছেন। এছাড়া অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিভিন্ন সরঞ্জম ধ্বংস করেন। খাস জমি উদ্ধারে রেখেছেন অবদান। মুজিব বর্ষের ঘর নির্মাণের দ্বায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯.৫৬ একর জমি অবৈধ দখল থেকে উদ্ধার করেন এবং এর মধ্যে ৭ একর জমি মুজিববর্ষের ঘর নির্মান করা হয়েছে। এ সকল দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের পরেও বিভিন্ন সরকারি সভা, দিবসসহ নানা অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থেকে ওই অনুষ্ঠানের উপস্থাপন ছাড়াও নিজ দপ্তরের সেবার নিয়ে মতবিনিময় ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধে উপস্থাপন করে সহযোগিতা কামনা করেন। সকাল থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত সেবা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
সহকারি শিক্ষক আনিচুর রহমান জানান, আমি নাম জারির আবেদন করেছিলাম। সকল নিয়ম মোতাবেক আমার নাম জারির কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পরে তা সংগ্রহ করতে আমার দেরি হলে তিনি আমাকে ফোন করে স্যার সম্মোধন করে আমার নাম জারি খতিয়ান নিতে বলেন, ওনার আচরনে আমি মুগ্ধ হই।
৬৫ বছরের আব্দুস সামাদ বলেন, আমি জমি সংক্রান্ত কাজে ভূমি অফিসে যাই, ওনি আমাকে চাচা বলে ডেকে তার কাছে বসায়ে আমার কথা শুনে সমাধান করে দেন। এমন অফিসার থাকলে আমরা সম্মান নিয়ে সেবা পাব। ৩৮ বছরের আশেকুল ইসলাম বলেন, আমি পারিবারিক জমির সমস্যা নিয়ে ওনার কাছে গিয়াছিলাম, ওনি আমাকে দেখে বলেন ভাই কি জন্য এসেছেন, কি সেবা দিতে হবে। পরে মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনে পরামর্শ দেন। তার সেবায় আচরণে আমি মুগ্ধ। তিনি সেবাগ্রহীতাদের সেবক হিসেবে সত্যি সেবা দিচ্ছেন।
এদিকে সেবার পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় ও পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতায় দেন গুরুত্ব। পরিকল্পনা মোতাবেক অফিসসহ অফিস চত্ত্বরের সৌন্দর্য করনের পাশাপাশি ফলজ, বনজ, ওষধি গাছ ও পুষ্টি জাতীয় বিভিন্ন সবজি রোপনের সিদ্ধান্ত নেন। অফিসে প্রবেশের পথে লাগিয়েছেন সুসজ্জিত বিভিন্ন ফুল গাছ, মাঠে নানা ধরনের ফল ও বনজ গাছের চারা রোপন করেন। এক পার্শ্বে পুষ্টি সমৃদ্ধ নানা সবজির চাষ করেছেন। সেবাপ্রত্যাশীদের সময় কাটানোর জন্য বটগাছের নিচে তৈরি করছেন ভূমি মঞ্চ ও একটি গাছেই ছাতারমত ছাউনি বানিয়ে গাছেই করছেন বসার স্থান। বানিয়েছেন বিনোদনমূলক নিঝর গংগা। নিঝর গংগায় কলস ও ব্যাঙগের মুখ দিয়ে পড়ছে পানি, সে পানিতে মাছ খেলছে আর শাপলা দুলছে। রাতে গাছে টিপ টিপ করে জ্বলে নানা কালারের বাতি। পাখিদের নিরাপদ আবাসস্থলের জন্য গাছে কলস বসিয়ে দিয়েছেন। ভূমি উদ্যান, পুস্পাঙ্গনের সাথে শোভা পাচ্ছে গার্ড সেভ ও সিটিজেন চার্টার। সবমিলিয়ে সবার দৃষ্টি কাড়ছে উপজেলা ভূমি অফিস। পরিকল্পিত এ সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন অনেকে ভূমি অফিস যাচ্ছে। যে যার মত ছবি বা সেলফি তুলছে এবং নিজেদের পছন্দের গাছ লাগাতে ও সবজি চাষে উৎসাহী হচ্ছে। তিনি সত্যিকারের উপজেলা ভূমি অফিসকে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে রূপ দিয়েছেন।
সমাজসেবক সাইদুজ্জামান, সাংবাদিক আব্দুল আলীম প্রামানিক, নারীনেত্রী আঞ্জুমানারা বলেন, এসিল্যান্ড সেবা ও পরিবেশ বান্ধব মানুষ।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম, ভাইস চেয়ারম্যান সাজু আহম্মেদ লাল, ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রউফসহ নানা শ্রেণীপেশার লোক জানান, সরকারি দ্বায়িত্ব সহকারী কমিশনার আন্তরিকতার সাথে এবং ভাল আচরণের মাধ্যমে মানুষের পেশা ও বয়স ভেদে সম্মোধন করে জনগণের দোড় গোড়ায় সেবা পৌঁছে দিচ্ছেন। এছাড়া অফিস এরিয়ায় নানা গাছ, সবজি চাষ করে সকল মানুষকে উৎসাহ যোগাচ্ছেন। ওনার সকল কর্মকান্ড ও কাজে আমরা গঙ্গাচড়ার মানুষ সন্তোষ্ট ও উৎসাহিত। তিনি অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। এজন্য তিনি সবার কাছে প্রিয় নয়ন কুমার।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নয়ন কুমার সাহা বলেন, প্রকৃতির প্রতি ভালোলাগা এবং প্রয়োজনীয়তা থেকে এই কাজগুলো করেছি। সুন্দর পরিবেশে সেবা গ্রহীতাগণকে তাদের কাঙ্খিত সেবা পৌঁছে দেয়ার মানসে ধীরে ধীরে ইউএনও স্যারগণের সহযোগিতায় ছোট ছোট কিছু কাজ এবং পরিবেশকে সুরক্ষাদানকারী প্রায় ৬০ প্রকৃতির বিভিন্ন ওষধি, ফলজ, বনজ ও ফুলের গাছ রোপন করা হয়েছে। এছাড়া করনাকালীন সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না থাকে সেই নির্দেশনার কারনে বিভিন্ন সবজি গাছ রোপন করা হয়েছে। সেখান থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনেকেই সবজি নিয়ে যান। তাছাড়া এই মুহূর্তে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় নিজ দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি ও স্বয়ংপূর্ণ হওয়ার বিকল্প নেই।
ডিবিএন/এসই/ মোস্তাফিজ বাপ্পি