আজ ঢাকাই চলচ্চিত্রের ‘মিয়া ভাই’খ্যাত কিংবদন্তি চিত্রনায়ক ও সাংসদ ফারুকের প্রয়াণ দিবস। ২০২৩ সালের আজকের এই দিনে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
তবে তিনি ইহলোকে না থাকলে বেঁচে আছেন তার অনবদ্য অভিনয় ও কর্মের মধ্যে। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা প্রায়শই তাকে স্মরণ করেন নানা পরিস্থিতিতে। তিনি শুধু একজন গুণী অভিনেতা, দর্শকনন্দিত নায়ক কিংবা সফল সংসদ সদস্যই ছিলেন না। এসবের বাইরে তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রকৃত অর্থে চলচ্চিত্র পরিবারের একজন অভিভাবক।
চলচ্চিত্রের নানা সংকটময় পরিস্থিতি তিনি দৃঢ় হাতে সামাল দিতেন। চলচ্চিত্রের মানুষের আপদে বিপদে সর্বদা এগিয়ে আসতেন। গ্রামীণ পটভূমিকায় তার অভিনয় এতোটাই সাবলিল ছিল যে, এক সময় তার ইমেজ গড়ে ওঠে গ্রামের প্রতিবাদী যুবকের।
নায়ক রাজ রাজ্জাক থেকে শুরু করে সোহেল রানা কিংবা আরও অনেক গুণী শিল্পীরা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমকে বলেছেন, গ্রামীণ পটভূমির ছবিতে নায়কদের মধ্যে ফারুক এবং নায়িকাদের মধ্যে কবরীর কোন তুলনা ছিল না। তবে ফারুক শুধু একটি ইমেজেই নিজেকে আটকে রাখেননি। কাজ করেছেন নানা ধরনের চলচ্চিত্রে। প্রতিটি ঘরনাতেই তার একাধিক ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র রয়েছে।
ফারুকের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, আজকের দিনটিতে ঘটা করে কোনও আয়োজন থাকছে না। তবে আজ ভোরেই পরিবারের সদস্যরা গাজীপুরে তার কবর জিয়ারত করেন। এছাড়া সেখানে মিলাদ ও এতিম-অসহায়দের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, চলচ্চিত্রের অন্তপ্রাণ এই নায়কের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীটা একেবারেই নীরবে নিভৃতে চলে যাচ্ছে। চলচ্চিত্র পরিবারের কোন আয়োজন চোখে পড়েনি।
ফারুকের পৈতৃক নিবাস গাজীপুরে। তবে তার জন্ম পুরান ঢাকায়, ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট। এই নগরের আলো-বাতাসে, অলি-গলিতে বেড়ে উঠেছেন তিনি। ছোটবেলায় ছিলেন বড্ড ডানপিটে স্বভাবের। পাড়া-মহল্লার বিভিন্ন অনুষ্ঠান পণ্ড করায় ছিলেন ওস্তাদ! সেই চঞ্চল কিশোর থেকে তিনি হয়ে উঠেছেন সক্রিয় রাজনীতিক, মুক্তিযোদ্ধা এবং সবশেষে কিংবদন্তি চলচ্চিত্র অভিনেতা।
তিনি সত্তর ও আশির দশকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন। পরবর্তীতে জ্যেষ্ঠ চরিত্রেও দাপট বজায় রেখেছেন ঢালিউডে। মজার ব্যাপার হলো, যে নামে তিনি খ্যাতি অর্জন করলেন, কালজয়ী হলেন, সেটা তার আসল নামই নয়! তার আসল নাম হলো আকবর হোসেন পাঠান দুলু।
মূলত দুলু নামেই পরিবার ও বন্ধু-স্বজনের কাছে পরিচিত ছিলেন তিনি। ফারুক নামটি এসেছে একটি ঘটনাচক্রে। সেই ঘটনা ২০১৬ সালে বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন অভিনেতা। ফারুক জানান, অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান, চলচ্চিত্র পরিচালক এইচ আকবর ও ফারুক নামের এক বন্ধুর পরামর্শে তিনি ‘ফারুক’ নামটি ধারণ করেছিলেন।
‘সুজন সখী’ নায়ক বলেছেন, ‘ছয় দফা আন্দোলনের পর আমি ওয়ান্টেড ছিলাম, যে কারণে নাম দিয়ে দিলো ফারুক। ওরা বলল, এই নামে তোমাকে প্রথমে কেউ ধরবে না। দ্বিতীয়ত, চলচ্চিত্রের নামগুলো ছোট হলে ভালো হয়, সুন্দর হয়- যেমন রাজ্জাক, উজ্জল, ফারুক, আলমগীর, শাবানা; নাম ছোট হলে ক্যাচি হয়।’
মুক্তিযুদ্ধের আগেই সিনেমায় নাম লেখান ফারুক। এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ তার প্রথম সিনেমা। এটি মুক্তি পায় ১৯৭১ সালে। জনপ্রিয়তা পান ১৯৭৩ সালে খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবির মাধ্যমে। পরবর্তীতে তাকে দেখা গেছে ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’, ‘সুজন সখি’, ‘নয়নমণি’, ‘আলোর মিছিল’, ‘লাঠিয়াল’, ‘মিয়া ভাই’, ‘সাহেব’ ইত্যাদি সিনেমায়।
অভিনয়ের জন্য ১৯৭৫ সালে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা (লাঠিয়াল) হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন ফারুক। ২০১৬ সালে এই রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন তিনি।
চলচ্চিত্রে দীর্ঘ অধ্যায় পেরিয়ে ২০১৮ সালে ফের রাজনীতির মাঠে নামেন ফারুক। ওই বছর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে ঢাকা-১৭ আসন থেকে জয়লাভ করেন তিনি।
কিন্তু অসুস্থতার কারণে সেভাবে দায়িত্ব পালন করে যেতে পারেননি। দীর্ঘ দিন ধরে তিনি কিডনি রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
২০২১ সালের মার্চে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় ফারুককে। সেখানে টানা চিকিৎসার পরও সুস্থ জীবনে আর ফিরতে পারেননি তিনি। অতঃপর ২০২৩ সালের ১৫ মে ওই হাসপাতালেই মারা যান ফারুক। আজ (১৫ মে) তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।
ডিবিএন/ডিআর/তাসফিয়া করিম