ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে আবারও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিচ্ছে সরকার। ১০ শতাংশ কর দিয়ে শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগ করে অপ্রদর্শিত অর্থ তথা কালো টাকা সাদা করা যাবে। তবে এ সুযোগ তারাই পাবেন, যারা শুধু উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে বিনিয়োগ করবেন। আগামী এক বছরের জন্য এ সুযোগ দেওয়া হবে। নতুন বাজেটে এ বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ আরও বাড়াতে এবারের বাজেটে করের আওতাও বাড়ছে। সার্মথ্যবান বা করযোগ্য আয় আছে, অথচ জালে নেই, এমন সবাইকে করের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বিনিয়োগ চাঙ্গা করতে প্রণোদনাসহ বিদ্যমান কর অবকাশের (ট্যাক্স হলিডে) মেয়াদ আরও বাড়ছে। ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমায় কোনো ছাড় না থাকলেও সারচার্জে (নির্দিষ্ট আয়ের বাইরে অতিরিক্ত সম্পদ) কিছুটা ছাড় দেওয়া হতে পারে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীনস্থ কর বিভাগকে শক্তিশালী করতে সম্প্রসারণের প্রস্তাব থাকছে। আদায় প্রক্রিয়া সহজ ও নতুন করদাতা চিহ্নিত করে নানামুখী সংস্কারের মাধ্যমে ২০১৯-২০ অর্থবছরে আয়কর খাতে সোয়া লাখ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের প্রস্তাব থাকছে। আগামী বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
মূলত ব্যক্তি তথা বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে কয়েক বছর ধরে খরা থাকলেও সরকার আশা করছে, এ সুযোগ দেওয়া হলে দেশ থেকে অর্থ পাচার কমবে এবং উদ্যোক্তারা স্থানীয় শিল্প স্থাপনে আরও উৎসাহিত হবেন।
উল্লেখ্য, বর্তমানে শুধু ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়ে প্রতিবর্গমিটারে নির্ধারিত অংকের টাকা দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যায়। এর বাইরে অন্য কোনো খাতে এ সুযোগ নেই। এখন নতুন করে উৎপাদনমুখী (ম্যানুফা্যকচারিং) শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগের শর্তে টাকা বৈধ করার সুযোগ দিতে চায় সরকার।
প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ২০০৩-০৪ অর্থবছরের বাজেটে প্রচলিত আয়কর অধ্যাদেশের ধারা ১৯ (এএএ) অনুযায়ী নির্ধারিত কর দিয়ে প্রথমবারের মতো দুই বছরের জন্য যে কোনো শিল্পে কালো টাকা বিনিয়োগ করে সাদা করার সুযোগ দেন। অবশ্য নানা সমালোচনা ও বির্তকের পরিপ্রেক্ষিতে পরে এ সুযোগ বাতিল করা হয়। দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় পর বিদ্যমান আইনের সেই ধারা পুনরুজ্জীবিত করে আবারও সুযোগটি দিতে চলেছে বর্তমান সরকার। তবে অর্থনীতিবিদরা বরাবরই কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে ঘোর আপত্তি জানিয়ে আসছেন। তাদের মতে, বারবার এ সুযোগ দেওয়া হলেও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি।
তবে নির্ধারিত হারে কর পরিশোধের মাধ্যমে টাকা সাদা করার সুযোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। এ সুযোগ নিয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই বাধা আছে। কারণ বিনিয়োগকারীর আয়ের উৎস সম্পর্কে এনবিআর কিংবা কর বিভাগের কর্মকর্তারা কোনো প্রশ্ন না তুললেও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সে সুযোগ রয়েছে। ফলে এ সুযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অব মানি লন্ডারিংয়ের (এপিজি) সদস্য। সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধে এপিজির সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। এদিকে ধারণা করা হয়, কালো টাকা সন্ত্রাস অর্থায়নে (টেরোরিস্ট ফাইন্যান্স) ব্যবহার হয়। এমন পরিপ্রেক্ষিতে এবারের বাজেটে আবারও নতুন করে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলে তা সুফল আনবে কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বর্তমানে একজন সামর্থ্যবান করদাতাকে নিয়মিত কর দেওয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত নিট সম্পদের জন্য বাড়তি কর দিতে হয়, যাকে বলা হয় সারচার্জ। বর্তমানে নূ্যনতম দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা সম্পদের জন্য কোনো সারচার্জ দিতে হয় না। আসন্ন বাজেটে আরও ছাড় দিয়ে আড়াই কোটি বা পৌনে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত সম্পদের বিপরীতে সারচার্জ ‘শূন্য’ নির্ধারণ করা হতে পারে।
কর অবকাশের মেয়াদ বাড়ছে: বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি, অবকাঠামো, পর্যটন, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে দেওয়া কর অবকাশের মেয়াদ চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত নির্ধারিত আছে। সূত্র জানায়, বিনিয়োগ বাড়াতে ও জিডিপির উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে কর অবকাশের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়িয়ে আগামী ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণের প্রস্তাব করা হচ্ছে। একই সঙ্গে আরও বেশ কিছু খাতকে নতুন করে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ফার্নিচার, কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদক শিল্প, চামড়া; গৃহস্থালি কাজে ব্যবহূত সব উপকরণ- যেমন ব্লেন্ডার মেশিন, ওয়াশিং মেশিন, প্রেগার কুকার, রাইস কুকার ইত্যাদি প্রস্তুতকারক শিল্প কর অবকাশ সুবিধা পাবে। এ নিয়মানুযায়ী বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু থেকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত আলোচ্য প্রতিষ্ঠান বছরে যে পরিমাই মুনাফা করবে, তার ওপর কোনো কর দিতে হবে না। তবে মেয়াদ শেষে প্রযোজ্য হারে কর দিতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী বর্তমানে বছরভিত্তিক ‘ক্রমহ্রাসমান’ হারে (বিদ্যমান যে রেট আছে তার চেয়ে কম) কর দিতে হয়। আগে ঢালাওভাবে কর অবকাশ সুবিধা ছিল। এর ব্যাপক অপব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেটে এ সুবিধা কিছুটা কঠোর করে শর্ত সাপেক্ষে ক্রমহ্রাসমান হারে ট্যাক্স হলিডে সুবিধা দিয়ে আসছে সরকার।
এক কোটি লোককে করের আওতায় আনা হবে: বর্তমানে ৪০ লাখ লোক ই-টিআইএন বা করের আওতায় আছে। এর মধ্যে বার্ষিক আয়কর রিটার্ন দেন ১৮ থেকে ১৯ লাখ। নতুন বাজেটে কমপক্ষে এক কোটি লোককে কর নেটে আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সব সিটি করপোরেশন এলাকায় যাদের ফ্ল্যাট, বাড়ি আছে, তাদের প্রত্যেককে বাধ্যতামূলক করের আওতায় আনা হবে। এনবিআর জরিপ করে দেখেছে, সব সিটি করপোরেশনে ২০ লাখ ফ্ল্যাট ও বাড়ির মালিকের এখনও কোনো টিআইএন নেই। এ ছাড়া ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সিটি করপোরেশন এলাকার বড় বিপণি বিতান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিককে করের আওতায় আনা হবে। সূত্র বলেছে, এদের প্রত্যেকের কর দেওয়ার সামর্থ্য থাকলেও বেশিরভাগই আওতার বাইরে রয়েছে। তাই বাজেটে বাদ পড়া যোগ্য সব করদাতাকে আওতায় আনার প্রস্তাব থাকছে। এনবিআর সূত্র বলেছে, বর্তমানে সারা দেশে এনবিআরের অধীন ৩১টি কর অঞ্চল আছে। নতুন বাজেটে কর অঞ্চলের সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হচ্ছে। এর বাইরে উৎসে কর আদায়, অডিট বা নীরিক্ষাসহ সাতটি ‘বিশেষায়িত কর অঞ্চল’ গঠনের প্রস্তাব থাকছে।
সুত্র : সমকাল