প্রদীপ কুমার দেবনাথ, নাসিরনগর ( ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে তিতাস নদীর পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বেষ্টিত নয়নাভিরাম জমিদার বাড়ি । বাড়িটিকে কেউ বলে রাজবাড়ি, কেউ বড়বাড়ি আবার কেউ বলে জমিদার বাড়ি। নাসিরনগর থেকে মাধবপুর যাওয়ার পথে উপজেলার শেষ সীমান্তে মাধবপুর ও নাসিরনগর উপজেলার সংযোগস্থলে হরিপুর গ্রামের রাস্তার পশ্চিম পাশে তিতাস নদীর পাড়ে চোখে পড়ার মতো সুবিশাল বাড়িটি। বাড়িটির পশ্চিম দিকে তিতাস নদীর ফাঁকা জায়গা। অনেক বড় বারান্দা ডিঙিয়ে মূল বাড়ি। দোতলা রাজবাড়িটি বিশাল। রাজবাড়ির সামনেই দিগন্ত বিস্তৃত হাওর।
তথ্যমতে, ১৮৭০ সালে তৎকালীন জমিদার কৃষ্ণ প্রসাদ রায় চৌধুরী বিশাল এ বাড়িটি নির্মাণ করেন। নাসিরনগর উপজেলার ১৫ কি.মি. দক্ষিণপূর্ব দিকে এই প্রাসাদটি অবস্থিত।
প্রায় ৪৮০ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত দুই গম্বুজ বিশিষ্ট শৈল্পিক নৈপুণ্য ও আড়ম্বরপূর্ণ স্থাপত্য শৈলীর ঐতিহ্যপূর্ণ এ তিনতলা জমিদার বাড়িটিতে প্রায় ৬০টি কক্ষ, রং মহল, দরবার হল, ধানের গোলা, গোয়ালঘর, নাট্যশালা, রান্নার ঘর, নাচ ঘর, মল পুকুর, খেলার মাঠ, মন্দির ও সীমানা প্রাচীর রয়েছে। বিশাল আয়তনের বাড়িটির পুরো ভবনের কোথাও কোনো রডের গাঁথুনি নেই। লাল ইট সুরকির গাঁথুনি দিয়ে তৈরি ভবনের দু’পাশে দুটি সুউচ্চ গম্বুজ সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছে, জমিদার বংশের ঐতিহ্যের কথা। দু’তলায় উঠার ছয় দিকে ছয়টি সিঁড়ি ও তিন তলায় উঠার দু’দিকে দুটি সিঁড়ি রয়েছে। বাড়তি পশ্চিম-উত্তর কোণে ছয়টি বেড রুম এবং মূল পুকুরের পূর্বপাড়ে চারটি ও পশ্চিম পাড়ে চারটি বেড রুম রয়েছে। বাড়ির পশ্চিম দিকে তিতাস নদীর পাড়ে সান বাধাঁনো ঘাট তীর থেকে নদীতে মিশেছে। উত্তর দিকে কৃষ্ণ প্রসাদ রায় চৌধুরী ও দক্ষিণ দিকে গৌরী প্রসাদ রায় চৌধুরীর সমাধি মঠ রয়েছে।
জানা যায় হরিপুরের জমিদারগণ বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের প্রভাবশালী জমিদারগণের উত্তরসুরী ছিলেন। তখন সুনামগঞ্জ, দোয়ারাবাজার, ছাতক, হবিগঞ্জ, আজমিরীগঞ্জ সহ এ এলাকার জনপদ এ জমিদারদের অধীনে কর প্রদান করতো। এছাড়া নাসিরনগরের গুনিয়াউক জমিদারদের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক ছিলো।
১৩৪৩ বাংলার ১২ চৈত্র (দোল পূর্নিমা) তারিখে কৃষ্ণ প্রসাদ রায় চৌধুরীর মূত্যুর পর পর্যায়ক্রমে বাড়িটির উত্তরাধিকার হন হরিপদ রায় চৌধুরী ও শান্তি রায় চৌধুরী। তাদের কাছ থেকে বাড়ির মালিকানা ও জমিদারি আসে উপেন্দ্র রায় চৌধুরী ও হরেন্দ্র রায় চৌধুরী। কালক্রমে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হওযার পর জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলে তারা বাড়িটি ফেলে কলকাতায় চলে যান। জমিদাররা বাড়িটি ফেলে যাওয়ার সময় পুরোহিতদের রেখে যায়। এখনও জরাজীর্ণ জমিদার বাড়িতে পুরোহিতদের বংশধরেরা বসবাস করছে।
এখানকার মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চলচিত্র নির্মাতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল অনেক আগেই। ভারতীয় জনপ্রিয় পরিচালক নারায়ণ ঘোষের পরিচালনায় ‘মধুমালতী’ (১৯৯৯), বাংলাদেশের শাকুর মাজিদের পরিচালনায় ‘নাইওরী’ (২০০১) এবং হুমায়ুন আহমেদের ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ (২০১২) সালে এ বাড়িতেই শুটিং করা হয়েছিল।
প্রতিদিনই সৌন্দর্য পিপাসু মানুষেরা দূর-দূরান্ত থেকে এখানে আসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বেষ্টিত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী জমিদার বাড়িটি দেখতে। স্থানীয়দের সাথে তাদেরও দাবি এটি একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হউক এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হউক।
প্রদীপ কুমার দেবনাথ, নাসিরনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)