তিমির বনিক, মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি: স্বাধীনতার শুচনালগ্নে ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলা। কমলগঞ্জের মাটিতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন হয়। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে বিপর্যস্ত হয়ে কমলগঞ্জের দখলদারিত্ব ছেড়ে পালিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর শত্রু মুক্ত হয় কমলগঞ্জের মাটিতে স্বাধীনতার পতাকা ওড়ায় বাঙালিরা।
কমলগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার জয়নাল আবেদীন জানান, প্রকৃতপক্ষে ৫ ডিসেম্বরই কমলগঞ্জ হানাদারমুক্ত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কমলগঞ্জে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই এখানে শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রস্তুতি। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অনুগত ৬০ জনের একটি দল তৈরি করে উপজেলার শমসেরনগর বিমানঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। ১০ মার্চ ক্যাপ্টেন গোলাম রসুলের নেতৃত্বে এক দল পাকিস্তানি সেনা মৌলভীবাজারে অবস্থান নেয়। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে তৎকালীন ছাত্রনেতা নারায়ণ পাল ও আব্দুর রহিম পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানোর দায়ে গ্রেফতার হন। পরে জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তিনি জানান, কমলগঞ্জ ছিল বামপন্থিদের সুদৃঢ় ঘাঁটি। তারা মওলানা ভাসানী ও হক-তোহায়া গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনালগ্নে বাকশালপন্থিদের নির্মূল করার অজুহাতে মেজর খালেদ মোশাররফকে কমলগঞ্জে পাঠানো হয়। তিনি ছিলেন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা গণহত্যা শুরু হলে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে জনতার কাতারে শামিল হন।
ঢাকায় এ গণহত্যার প্রতিবাদে ২৬ মার্চ কমলগঞ্জে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে মিছিল বের হয়। পাকিস্তানি সেনারা সেই মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালালে সিরাজুল ইসলাম নামে এক বৃদ্ধ শহীদ হন। এই হত্যাকাণ্ডে উপজেলাবাসীর মনে জ্বলে ওঠে প্রতিশোধের আগুন। স্থানীয় বাঙালি ইপিআর ও পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরাও একাত্মতা ঘোষণা করে সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে। ২৮ মার্চ শমসেরনগর পুলিশ ফাঁড়ির সব অস্ত্র উঠিয়ে আনা হয়। মালগাড়ির বগি দিয়ে ভানুগাছ-শমসেরনগর-মৌলভীবাজার রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া হয়। ২৯ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী খবর পেয়ে আবারও কমলগঞ্জে আসে। সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সেনারা ভানুগাছ থেকে শমসেরনগরে এলে মুক্তিসেনাদের অতর্কিত আক্রমণে ক্যাপ্টেন গোলাম রসুলসহ নয়জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। স্বাধীনতার শুচনালগ্নের এই প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধে প্রচুর অস্ত্র-গোলাবারুদসহ পাকিস্তানিদের দুটি গাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বপ্রথম এই বিজয় লাভের পরদিনই কমলগঞ্জে মুক্তিপাগল জনতার এক বিরাট সমাবেশে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা পরিষদ। এরপর থেকেই নিয়মিত চলতে থাকে দলে দলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ। ২৮ মার্চের পর পাকিস্তানি বাহিনী জল, স্থল ও আকাশপথে কমলগঞ্জে ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনী তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র মোকাবিলায় অসীম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে।
এ উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তিনটি ঘটনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হচ্ছে- পাত্রখোলা বাগান, ধলাই বাগান ও ভানুগাছের যুদ্ধ। ন্যাপের নেতা মফিজ আলী, ক্যাপ্টেন মোজাফফর আহমদ, আওয়ামী লীগ নেতা এমএ গফুর, ময়না মিয়া, ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমান প্রমুখের সাহসী নেতৃত্বে কমলগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়েন। এখানকার বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন মুক্তিবাহিনী ও সেনাবাহিনী প্রধান এমএজি ওসমানী, বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, ব্রিগেডিয়ার আমিন আহম্মদ ও মেজর জিয়াউর রহমানসহ অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা। উপজেলার বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমান, ল্যান্স নায়েক জিল্লুর রহমান, সিপাহি মিজানুর রহমান, সিপাহি আবদুর রশিদ, সিপাহি শাহজাহান মিয়াসহ নাম না জানা অনেকেই। ক্যাপ্টেন মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে পরিচালিত বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনের লোমহর্ষক পর্যায়গুলো শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ বিভিন্ন বেতার মাধ্যম থেকে তার ওপর মন্তব্যও করা হয়েছে বহুবার। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে শমসেরনগর মুক্ত করেছেন তিনি। শমসেরনগর যুদ্ধের আরও এক অগ্রসেনানি ছিলেন সৈয়দ মতিউর রহমান। ডিসেম্বরের ৩ তারিখ শমসেরনগর মুক্ত হওয়ার প্রাক্কালে তার অসম সাহসী যুদ্ধ পরিচালনা দেখে চমৎকৃত হয়েছিলেন শমসেরনগর ডাকবাংলোয় অবস্থানকারী তৎকালীন সময়ের মিত্রবাহিনীর ক্যাপ্টেন চাতওয়াল সিং।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ৩ ডিসেম্বর শমসেরনগর এলাকা শত্রুমুক্ত করে ৫ ডিসেম্বরে ভানুগাছ এলাকায় মুক্তি বাহিনী ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধের পর কমলগঞ্জ সদর থেকে পাকিস্তানিরা পিছুহটে মৌলভীবাজারের দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কামুদপুরসহ গোটা কমলগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।