প্রদীপ কুমার দেবনাথ, বেলাব ( নরসিংদী)।। প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলা। এখানে উয়ারী-বটেশ্বরে রয়েছে আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন দূর্গ-নগরী। রাজা নরসিংহের বহু প্রাচীন স্মৃতি বিজরিত বেলাব উপজেলার পাটুলি ইউনিয়নের ভাবলা গ্রামে ভাওয়াল রাজার নিকট থেকে তালুকদারি ক্রয় করে তালুকদার বাড়ি খ্যাতি অর্জন করা ভাবলা ‘বাবুর বাড়ি’ আজও টিকে আছে বহু পুরাতন মাটির চৌচালা ঘর নিয়ে।
বিভিন্ন পুরাতন কাগজপত্র ও দলিল দস্তাবেজ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় প্রায় ৫০০ বছরেরও অধিক সময় ধরে এ বাড়িটি অবস্থিত। তবে বাংলা আনুমানিক ১২৪১ সন ইংরেজি ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে আলোচনায় আসে এ বাড়িটি। তখন এ বাড়ির কর্তা দূর্গাচরণ চক্রবর্তী তৎকালীন ভাওয়াল রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর নিকট থেকে বিশাল তালুকদারি ক্রয় করে ‘তালুকদার বাড়ি’ খ্যাতি লাভ করেন। ৫৮ বছর পর্যন্ত তিনি তালুকদারি পরিচালনা করে মারা যান। দূর্গাচরণ বাবুর শেষ প্রয়াণের পর শ্যামাচরণ চক্রবর্তী তার অপর দুই ভাই গঙ্গাচরণ চক্রবর্তী ও অন্নদাচরণ চক্রবর্তীকে সাথে নিয়ে বিশাল তালুকদারির দায়িত্ব নেন। তিনটি কাচারির অধীনে তারা এ তালুকদারি পরিচালনা করতেন।
এখানে তখন পর্যায়ক্রমে নায়েব হিসেবে হরকুমার চক্রবর্তী (কসবা), অধর চন্দ্র গুহ, দেবেন্দ্র চক্রবর্তী (পাটুলী), গেনেন্দ্র চক্রবর্ত্তী (শিবপুর) প্রমুখগণ চাকরি করতেন। তৎকালীন সময়ে এই তালুকদার বাড়ি বর্তমান ভাবলা বাবুর বাড়ির সদস্যদের ভাওয়াল রাজ পরিবারে যাতায়াত ছিল নিয়মিত। তালুকদার বাড়ির সম্পত্তি গুলো তিনটি উপজেলার বিভিন্ন মৌজায় অবস্থিত। তথ্যমতে গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও, বড়গাঁও, সাফাইশ্রী, বরাদিয়া, ভরাসন মৌজার জমি, মনোহরদী উপজেলার পাঁচকান্দি, চুলা, কাটাবাড়িয়া, বারুদিয়া, মাধুশাল, খারাবো, সর্বলক্ষণা, জামালপুর, পাইকান, চন্ডীতলা এসব মৌজা।
বেলাব উপজেলার মোগা, গলগলিয়া, চন্ডীপাড়া, ভাওয়ালের চর, লতিফপুর, চরসায়েট, রাজারামপুর এর মৌজাসমূহ বাবুরবাড়ির এ তালুকদারি এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাছাড়া পুরো অষ্টগ্রাম মৌজাও এ তালুকদার এস্টেটের নিজস্ব জমি ছিল। বিশাল এ তালুকদারি দেখভাল তালুকদার তিন ভাই ছাড়াও তাদের ছেলেরা দেখাশুনা করতো।
দূর্গাচরণ চক্রবর্তীর ছোট ছেলে অন্নদাচরণ ছিলেন যেমন শিক্ষিত তেমনি জনপ্রিয়। তিনি ১৯২৭ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ছিলেন। বৃটিশ আমল ও তৎপরবর্তীকালে স্বনামধন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি ২৭ বছর পাটুলি ইউনিয়ন বোর্ড পরিচালনা করেন। সেরা প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাষ্ট্রীয় পদক সহ বহু সম্মানজনক পদক অর্জন করেছিলেন কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততার কারণে।
তালুকদার বাড়ির সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার জন্য সরকারি আদেশে একটি পোস্টঅফিস স্থাপিত হয়েছিল। আজও সেই ঐতিহাসিক মাটির তৈরি একটি জরাজীর্ণ ঘর কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলা তালুকদার বাড়ি যা বর্তমানে বাবুর বাড়িতে বর্তমানে ধ্বংস প্রাপ্ত তিনটি ভিটা, পুরাতন বিশাল মন্দিরের উঁচু ভিটা ( যেখানে বর্তমানে ছোট একটি মন্দির স্থাপিত হয়েছে), পূর্বপাশে ক্ষতিগ্রস্থ পুকুর, পুকুরের পাড়ে প্রাচীন কাঁঠাল গাছ ( এক সময় অনেক থাকলেও সময়ের পরিক্রমায় মাত্র ২/৩ টি গাছ আছে)।
কথিত আছে কোন কোন গাছে হাজার হাজার কাঁঠাল ধরতো বলে এগুলোকে মানুষ হাজারি গাছ বলে ডাকত। ভাওয়াল রাজ পরিবারের কেউ আসলে অন্যান্য উপাদেয় খাবারের সাথে হাজারি গাছের কাঁঠাল (যা অতি সুস্বাদু) দিয়ে আপ্যায়ণ করা হতো। এসব ছাড়াও বাড়ির পশ্চিম দিকে ১৭০- ১৮০ বছরের পুরনো লিচু গাছ, ১২০/১৩০ বছর প্রাচীন আম, কাঁঠাল, জাম সহ প্রায় সব ধরনের ঔষধি গাছের বিশাল সমাহার দেখা যায়। বাড়ির পূর্ব পাশে এখনও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নারীদের জন্য সংরক্ষিত পাশাপাশি তিনটি আটচালা ঘর ছিল। যে ঘরগুলোর ভিটের অস্তিত্ব আছে। যেখানে বিভিন্ন এলাকা, পাড়া-মহল্লার নারীরা কীর্তন,পূজা উপকরণ প্রস্তুত বা অনুষ্ঠানাদি প্রত্যক্ষ করতো। বাড়ির সামনের কাচারি ঘরে নিয়মিত হিসেব নিকেশ চলতো। এলাকার অনেক কর্মচারী সেখানে কাজ করতো। বাড়ির পাহাড়ায় তখন থাকত বৃটিশ সেনা সদস্য নেপালী বংশোদ্ভূত জং বাহাদুর। তার সেই বিশাল বডি বেল্ট এবং ব্যবহৃত জিনিসপত্র এখনও আছে।
পরবর্তীকালে তালুকদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে এ বাড়ির বংশধরেরা জীবিত থাকা সত্বেও বিভিন্ন উপায়ে এক শ্রেণির লোভী মানুষদের কারণে জমি জমা, বাড়ির জিনিসপত্র বেহাত হয়। ধ্বংসশেষ আঁকড়ে ধরেই এখনও টিকে আছেন সেই পরিবারের সদস্যরা।
(বিস্তারিত পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হবে)।