একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত ফলাফলের পর বিএনপির ভিতরে-বাইরে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। দল গোছানো নিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। ভোটে জামায়াতে ইসলামীর হাতে ধানের শীষ প্রতীক তুলে দেওয়ায় দেশি-বিদেশি চাপ ও অস্বস্তি বেড়েছে। পাশাপাশি গুটিকয়েক এমপি নিয়ে সংসদে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের টানাপড়েন চলছে।
এর রেশ ধরেই গত বৃহস্পতিবার মতিঝিলে ড. কামালের চেম্বারে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএনপির কোনো প্রতিনিধিই অংশ নেননি বলে জানা গেছে। অবশ্য শারীরিক অসুস্থতার কারণে বৈঠকে যাননি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অন্য দুই প্রতিনিধি যানজটের কারণে যেতে পারেননি বলে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে বলা হয়।
বৈঠকে বিএনপির যোগদান না করা প্রসঙ্গে অবশ্য নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টকে কেন্দ্র করে বিএনপির কোনো রাগ-অভিমান আছে বলে আমি মনে করি না। তবে তারা বড় দল। নানা মত বা রাগ-অভিমান থাকতে পারে। সেটা একান্তই তাদের বিষয়। তবে ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে কোনো ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ নেই।’
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিশেষ করে সিনিয়র নেতৃত্বে সুদৃঢ় ঐক্য ছিল। তৃণমূলেও বিভেদ কমিয়ে আনতে পেরেছিল দলটি। কিন্তু ভোটের মনোনয়ন ফরম বিক্রির পর থেকেই ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাড়তে শুরু করে। নির্বাচনে পরাজয়ের পর সিনিয়র নেতারা পরস্পরকে দোষারূপ করছেন। স্থায়ী কমিটিতেও বিভাজন স্পষ্ট। একজন আরেকজনকে সরকারের এজেন্ট বলেও মন্তব্য করছেন। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও যারা বিজয়ী হয়েছেন তাদের নিয়েও নেতাদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন। সংসদে তারা গেলে সরকারের এজেন্ট হিসেবে ভূমিকা পালন করবে বলেও মনে করেন নেতাদের একটি অংশ। স্থায়ী কমিটির একটি অংশ এখনই দল পুনর্গঠনের দাবি তুলছে।
তারা বলছেন, লাখ লাখ নেতা-কর্মী মামলা-হামলায় জর্জরিত। এক্ষেত্রে ত্যাগীদের দিয়ে দল পুনর্গঠন করতে হবে। প্রয়োজনে বয়স্ক ও বিতর্কিতদের সরে যেতে হবে। তরুণ নেতৃত্বকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। শুক্রবার বিকালে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সরাসরি দল পুনর্গঠনের পক্ষে মত দেন। তবে তাদের সঙ্গে দ্বিমত করছেন স্থায়ী কমিটির অন্য সদস্য ও মধ্যসারির নেতারা।
এই অংশের মতে, কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির আগে বিএনপির কাউন্সিল বা বড় ধরনের কোনো পুনর্গঠনে হাত দেওয়া যাবে না। এখন সবার আগে প্রাধান্য দেওয়া উচিত বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনে। তা আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি রাজপথের আন্দোলনেও হতে পারে। তবে অঙ্গ সংগঠনের অসম্পূর্ণ কমিটি বা তৃণমূল পর্যায়ের কমিটি করা যেতে পারে। ভোটের আগে আন্দোলন নিয়েও নেতারা দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন।
স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেছেন, আমরা বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। কিন্তু আন্দোলন কোথায়? সবাই তো যার যার নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। নির্বাচনের পর সেই ঐক্য আরও সুসংহত রয়েছে। বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বা ২০ দলে কোনো ভুল বোঝাবুঝি নেই। অনির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’
জানা যায়, নির্বাচনের পর হঠাৎ বিএনপির সঙ্গে টানাপড়েনের মুখে পড়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। বিশেষ করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম দল গণফোরামের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ঘটে। সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের নানা বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা হয়। ঐক্যফ্রন্টকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলেও স্থায়ী কমিটির কোনো কোনো সদস্য মন্তব্য করেন। এরই সূত্র ধরে বৃহস্পতিবার বিকালে ঐক্যফ্রন্টের পূর্বনির্ধারিত স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে যাননি বিএনপির প্রতিনিধিরা।
সূত্রে জানা গেছে, ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে চাপ দিচ্ছে। কিন্তু কৌশলগত কারণে আপাতত জামায়াতকে ছাড়বে না বিএনপি। এ নিয়ে ভিতরে ভিতরে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বেশ দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। গণফোরামের বিজয়ী প্রার্থীরা শিগগিরই সংসদে যেতে চান। তাদের যুক্তি, সরকারের বিরুদ্ধে সংসদের ভিতরে-বাইরে ঝড় তুলতে হবে। কিন্তু কারাবন্দী বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়াই সংসদে না যেতে দলের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এ নিয়েও বিএনপির সঙ্গে গণফোরামের টানাপড়েন চলছে।
জানা যায়, কারান্তরীণ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ইস্যুতে আন্দোলন-কর্মসূচিতেও অনীহা ঐক্যফ্রন্টের কোনো কোনো দলের। তাদের কেউ কেউ আড়ালে বলছেন, শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বে কোনো বিতর্কিত কিংবা সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে রাখা যাবে না। ফ্রন্ট নেতাদের এই দাবির আওতায় তারেক রহমানও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পদে থাকতে পারবেন না। এসব বিষয় নিয়েও ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের সঙ্গে বিএনপির মতবিরোধের সৃষ্টি হয় বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের কোনো অবনতি হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টে কোনো মনোমালিন্য নেই।’ একই প্রশ্নের জবাবে গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, বৃহস্পতিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অসুস্থ ছিলেন। তাই আসতে পারেননি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যের আসার কথা ছিল। তারাও অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় তারা আসতে পারেননি।