দুবাইভিত্তিক কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান এমটিএফই (মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ) বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে ২০২১ সালে। তিন বছরে এমটিএফইতে শুধু বাংলাদেশ থেকেই ৪২ লাখ মানুষ যুক্ত হয়। প্রাথমিক অবস্থায় এমটিএফই অ্যাপে যুক্ত প্রত্যেকেই ৬১, ২০১, ৫০১, ৯০১ ও ২ হাজার ডলার ডিপোজিট করেন। বেশি টাকা আয় করতে কেউ কেউ আবার ৫ হাজার ডলারের বেশিও বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে কেউ জমানো টাকা, কেউবা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে আবার কেউ জমি বন্ধক রেখে বিনিয়োগ করেছিলেন। বর্তমানে তারা সবাই নিঃস্ব।
পরিশ্রম ছাড়া ঘরে বসে বিনিয়োগ করে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে গ্রাহকের প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এমটিএফই। অনলাইন ট্রেডিং এই প্রতিষ্ঠানটি তাদের গ্রাহকদের লাভের অংশ দেওয়া তো দূরের কথা বরং আরও ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে।
জানা গেছে, গত ৭ আগস্ট সিস্টেম আপগ্রেডের কথা বলে গ্রাহকদের টাকা উত্তোলন সেবা বন্ধ করে এমটিএফই। ফলে অনেকেই অপেক্ষায় ছিলেন যে সিস্টেম আপগ্রেড হওয়ার পর টাকা তুলবেন। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) রাতে হুট করে প্রায় সব গ্রাহকের ভার্চুয়াল অ্যাকাউন্ট ঋণাত্মক দেখানো শুরু করে অ্যাপটি। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, তাদের ব্যবসায় লোকসান হয়েছে। এজন্য উল্টো গ্রাহকদের কাছ থেকেই তারা টাকা পাবে।
এমটিএফই’র বেশ কয়েকজন গ্রাহক জানান, অ্যাপটিতে কেউ ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন তাকে প্রায় ১৩ ডলার লাভ দেওয়া হতো। তবে এত অল্প বিনিয়োগে তো বড় লাভ আসবে না। সেজন্য অনেকে ৫ হাজার, ১০ হাজার, এমনকি ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন। বিনিয়োগ যত বেশি, লাভও তত বেশি ছিল। এমনকি প্রতিমাসে বিনিয়োগের প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশ পেতেন গ্রাহকরা। এমটিএফইতে শুধু বিনিয়োগের ওপর লাভই নয়, কাউকে বিনিয়োগ করাতে পারলে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পাওয়া যেত। এমন করে কারও মাধ্যমে ১০০ জন গ্রাহক বিনিয়োগ করলে তার পদবি হতো ‘সিইও’। কমিশন আর নিজের বিনিয়োগের অর্থ মিলে ওই কথিত সিইও মাসে ১৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারত। আর কোম্পানিটি গ্রাহকদের বলতো, ডলারগুলো দিয়ে তারা ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবসা করছে এবং সেখান থেকেই গ্রাহকদের লভ্যাংশ দিচ্ছে। গ্রাহকরা সেটাই বিশ্বাস করে বিনাপরিশ্রমে লাভের আশায় বিনিয়োগ করতো। কিন্তু তারা কখনও ভাবেননি যে প্রতিষ্ঠানটি এভাবে সবার টাকা মেরে দিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে। এখন উল্টো তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে কোম্পানি আরও অর্থ পাবে বলে মাইনাস চিহ্ন দেওয়া হয়েছে। লাভের আশায় এসে উল্টো ঋণের বোঝাও ধরিয়ে দিয়েছে তারা। এতে করে যারা দ্রুত আয় করার স্বপ্ন নিয়ে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, তারা এখন সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসেছেন।
এদিকে, বিএনপি থেকে এমটিএফইতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিনিয়োগকারী ছিল। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হয়ে এ প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করেছিলো তারই আস্থাভাজন ইশরাক হোসেন। দেশ ও প্রবাস থেকে প্রতি মাসে আসা কোটি কোটি টাকার সিংহভাগ তারেকের নির্দেশে ইশরাক হোসেন দিয়েছিলেন, এই এমটিএফই কোম্পানিতে। বর্তমানে কোম্পানিটি গায়েব হয়ে যাবার পর ইশরাক হোসেন হজ্ব করতে সৌদি আরব গিয়েছেন।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গণমাধ্যমকে জানান, বিগত তিন বছর যাবত বিএনপির কোনো কোষাধ্যক্ষ ছিলো না। তাই দলের খরচের সব টাকা ইশরাক হোসেনকে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তারেক রহমান। এখন দেখি ইশরাক হোসেন অতিরিক্ত লাভের আশায় দলের সব টাকা এমটিএফই নামক এমএলএম কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছিলেন। বিএনপির অন্যান্য কর্মীদের মুখে শুনেছি কোম্পানিটি প্রথম দিকে আমাদের লাভ দিয়েছিলো, যার পুরো টাকা-ই তারেক রহমানকে পাঠানো হয়। এখন কোম্পানি পালিয়ে গেলো। কোম্পানিটি যাবার আগে আমাদের দলের প্রায় ৫০ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গণমাধ্যমকে আরো জানান, কোম্পানিটি হাওয়া হয়ে যাবার পর থেকে তারেক রহমান আমাদের ফোন ধরছে না। এতোগুলো টাকা চলে গেলো কেউ কোনো কথা বলছে না। এসব মূলত বিগত তিন বছর দলের পক্ষ থেকে কোষাধ্যক্ষ না থাকার পরিণাম ভোগ করলাম আমরা। দলের প্রায় ৫০ কোটি টাকা হাওয়া হওয়ায় পর এখন আমাদের টনক নড়েছে। তাই বাধ্য হয়ে কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে হলো। জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এম রশিদুজ্জামান মিল্লাতকে কোষাধ্যক্ষ মনোনীত করেছে বিএনপি। তিনি জামালপুর-১ (দেওয়ানগঞ্জ-বকশীগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য।
অন্যদিকে, সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগ) রেজাউল মাসুদ গণমাধ্যমকে জানান, আমরা এর আগেও এ ধরনের অ্যাপের বিরুদ্ধে অনেকবার অভিযান পরিচালনা করেছি। এমটিএফই’র বিষয়ে নজরদারি চলছে। বাংলাদেশে এর যারা পরিবেশক বা প্রচারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদের আমরা আইনের আওতায় আনব। এ ছাড়া কেউ যদি অভিযোগ দেন, সে বিষয়েও আমরা ব্যবস্থা নেব। এমটিএফই একটি ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম চক্র। তাদের কার্যক্রম ছিল সম্পূর্ণ বায়বীয়।
ডিবিএন/এসই/ এমআরবি