তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: মৌলভীবাজার সদর উপজেলার নাজিরাবাদ ইউনিয়নের আটঘর গ্রামের অনেক জায়গায় কাদাজল মারিয়েখনো প্রতিদিন হাজারো মানুষকে তাদের গন্তব্যে ফিরতে হয়। আটঘর এলাকার আটঘর পয়েন্ট থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড নিয়ন্ত্রণাধীন ওয়াবদা বাঁধ পর্যন্ত দুই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়ক এখনও সম্পূর্ণ কাঁচা।
এলাকাবাসী জানান, সড়কটি ২০১১ সালে প্রয়াত সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য থাকাকালে তাঁর সহায়তায় এলাকাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে রাস্তা পাকাকরণের জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অর্ন্তভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আটঘর পয়েন্ট থেকে ওয়াবদা বাঁধ পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রাস্তা পাকাকরণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করা হলেও শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়নি অদৃশ্য কোন কারণে আজো তা অজানা। রাস্তাটি দীর্ঘদিন যাবত পাকা না হওয়ায় বর্ষায় হাজারো মানুষ দুর্ভোগে পড়েন।
বিষয়টি নিয়ে এলাকার মানুষের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। নাজিরাবাদ ইউনিয়নের আটঘর, নারাইনপাশা, মানিকপুর, কৈল্যাণপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের কয়েকহাজার মানুষ প্রতিদিন চলাচল করেন আটঘর পয়েন্ট থেকে ওয়াবদা বাঁধ পর্যন্ত নির্মিত কাঁচা রাস্তা দিয়ে। জেলার তিনটি বড় হাওরের মধ্যে হাইল হাওরের পার্শ্ববর্তী ও স্থানীয়দের কাছে মানিক হাওর হিসেবে পরিচিত হাওর যেতে হয় ওই সড়ক দিয়েই। প্রত্যেক বছর বোরো মৌসুমে হাজার হাজার মণ বোরো ধান হওরের কৃষি জমি থেকে সংগ্রহ করতে হয় এই রাস্তা দিয়েই। কিন্তু কাঁচা রাস্তা হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে রাস্তাটি বর্ষার পানিতে জমাট হয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যায়।
কাদাজল মারিয়েই হাইল হাওর ও মানিক হাওর থেকে সদর উপজেলার আমতৈল ও আপারকাগাবালা ইউনিয়ন এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নসহ দুই উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের শত শত কৃষক তাদের উৎপাদনকৃত বোরো ধান সংগ্রহ করতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হন। বর্ষা মৌসুমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা চলাচল করতে গিয়ে দুর্ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছেন পথচারীসহ এলাকাবাসী। হঠাৎ করে কোনো দুর্ঘটনা কিংবা গর্ভবতী নারীদের সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছানোও বেশ কষ্টসাধ্য। রাস্তাজুড়ে কাদাজল জমে থাকায় বর্ষায় রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সসহ কোনো যানবাহনই চলাচল করতে পারে না।
সড়ক পার হলেই বিশাল বিশাল বিল, গবাদিপশুর খামার, কৃষি আর নানা জলজ সম্পদে ভরপুর বৃহত্তম হাইল হাওর ও মানিক হাওর রয়েছে এখানে। হাওরে পৌঁছতে হলে এ সড়কই একমাত্র অবলম্বন। এসব কারণে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে সড়কটির গুরুত্ব বেশি।
এলাকার কাঁচা ওই সড়ক দিয়ে প্রতিদিন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, কৃষক, জেলে, ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার কয়েক হাজার মানুষ যাতায়াত করে। আর এটিই তাদের যাতায়াতের একমাত্র সড়ক। হাওর আর কৃষিকেন্দ্রিক জীবিকানির্বাহ যাদের একমাত্র পেশা তারাও ওই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করেন নিয়মিত।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. মহসিন আহমদ বলেন, ২০১৪ সালে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আমজদ মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি দায়িত্বে থাকাকালে রাস্তাটি পাকাকরণের জন্য এলাকাবাসীর পক্ষে আবেদন করেও ব্যর্থ হই। আমরা অবহেলিত, এর অবসান চাই।
স্থানীয় কৃষক মো. আতাউর রহমানসহ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাস্তার সমস্যার কারণে হাওর এবং হাওর পাড়ের শত শত কৃষকের গবাদিপশু ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য দূর থেকে পাইকারদের আসতে বেগ পোহাতে হয়। এতে করে অনেকটা কম দামে গবাদিপশু বিক্রয় করতে বাধ্য হন কৃষকরা, ফলে অনেকেই গবাদিপশু পালন এক প্রকার বাদই দিয়ে দিয়েছেন। হাওর থেকে হাজার হাজার মণ ধান উৎপাদন হলেও যাতায়াতের সমস্যা থাকায় সেগুলোও অনেকটা কম দামে বিক্রি করতে হয় স্থানীয় কৃষকদের।
কৃষক রুহেল মিয়া বলেন, হাওরে এ বছর বোরো ধানের ফলন ভালো হলেও যানবাহন সমস্যার কারণে প্রতি মণ ধান অন্তত দুইশ টাকা কম মূল্যে বিক্রি করতে হয়, তবে রাস্তা পাকা হলে শুধু কৃষি নয় সব ক্ষেত্রে সুফল ভোগ করবেন এ অঞ্চলের কৃষক আর হাওরের জেলেরা।
দীর্ঘ কয়েক যুগ যাবত হাওরে গবাদিপশু পালন করেন কৃষক আনিছ আলী। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বর্ষায় এ রাস্তায় চলাচল করা সম্ভব হয় না। হাঁটু পর্যন্ত দেবে যায়। বিকল্প হিসেবে তখন নৌকা দিয়েই চলাচল করতে হয়। তাঁর ক্ষোভ সব জায়গায় রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন ও পরিবর্তন হলেও আমরা অবহেলার শিকার হচ্ছি যুগ যুগ ধরে।
নাজিরাবাদ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মাহমুদুর রহমান বলেন, আটঘর পয়েন্ট থেকে বাঁধের সংযোগস্থল পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রাস্তাটি পাকাকরণের জন্য বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। রাস্তাটি পাকা হলে বদলে যাবে এলাকার মানুষের সামগ্রিক জীবনমান। হাওরজুড়ে বাড়বে কৃষি উৎপাদনসহ মৎস্য আহরণ।
নাজিরাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, রাস্তাটি এলজিইডির হলেও দুই বছর পূর্বে স্থানীয় এলাকাবাসীর নিজ অর্থায়নে কাঁচা রাস্তাটি সংস্কার করা হলেও বর্ষার পানিতে ফের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি এর আগেও রাস্তাটি পাকাকরণের জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। আগামীতেও রাস্তাটির পাকাকরণের ব্যাপারে আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
সদর উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী মো. আলমগীর হোসেন বলেন, বর্তমানে সদর উপজেলায় এলজিইডির কোনো প্রকল্প নেই, আগামীতে একটি উন্নয়ন প্রকল্প আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে রাস্তাটি পাকাকরণের ব্যবস্থা করব বলে তিনি জানান।