৪০ মাস আগে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর শুরু হয় পদ্মা বহুমুখী সেতুর প্রকল্পের নির্মাণকাজ। সেদিন মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা নদীতে বিশাল হ্যামার দিয়ে সেতুর ৭ নম্বর খুঁটির (পিয়ার) পাইল বসানো শুরু হয়। কিন্তু এরপরই ধরা পড়ে সেতুর নির্মাণকাজের নানা জটিলতা। পাইল বসাতে গিয়ে নদীর তলদেশে দেখা মেলে নরম মাটির স্তর। একে একে ধরা পড়ে ১১টি খুঁটিতে একই ধরনের বিপত্তি। এর মধ্যে সেতুর ৬ ও ৭ নম্বর খুঁটির পাইল বসাতে গিয়ে সবচেয়ে বড় জটিলতা দেখা দেয়। মাওয়া প্রান্ত দিয়ে যে সেতুর নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল, তার সবই যেন ওলট–পালট হয়ে যায়। অবশেষে সেই ৬ ও ৭ নম্বর খুঁটির পাইল বসানোর কাজ মঙ্গলবার শেষ হচ্ছে।
কয়েক মাসের মধ্যে এই দুটি পিয়ারের পুরোপুরি কাজ শেষ হবে—এ কথা জানিয়ে আজ সোমবার পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন এক প্রকৌশলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কী ভোগান্তিই না হয়েছিল আমাদের। ১১টি পিয়ারের (খুঁটি) পাইল নদীর যেখানে ড্রাইভিংয়ের কথা ছিল, তার তলদেশ নরম মাটির স্তরের কারণে পরিকল্পনা বদলে ফেলতে হই। বাধ্য হয়ে সেতু নির্মাণের সব যন্ত্রপাতি মাওয়া থেকে গুটিয়ে নেওয়া হয় পদ্মার ওপারে শরীয়তপুরের জাজিরায়। সেখান থেকেই পদ্মা সেতুর কাজ চলতে থাকে।’
ওই প্রকৌশলী বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজটি শেষ করে ফেলেছি। এরপর কংক্রিটের ঢালাই দেওয়া হবে। এরই মধ্যে পিয়ার-৭–এর পাইল ড্রাইভিং শেষ হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে গভীর মাঝনদীতে কাল পিয়ার-৬–এর পাইল ড্রাইভিং কাজ শেষ হবে।’
পদ্মা সেতু প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, নকশার সমস্যা সমাধানে কাজ শুরু করে ব্রিটিশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাউই (COWI) ইউকে লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির বিশেষজ্ঞরা মাটি পরীক্ষার প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন তথ্য যাচাই করেন। তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী, কাদামাটির পরই শক্ত মাটি না পাওয়ায় পদ্মা সেতুর ১১টি খুঁটির মধ্যে ছয়টি পাইলের সঙ্গে আরও একটি পাইল বাড়ানো হয়। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি এসব খুঁটির নতুন নকশার অনুমোদন দেয় পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দল। নতুন নকশা পেয়েই জোরেশোরে শুরু হয়ে যায় ১১টি খুঁটির পাইল বসানোর কাজ।
জানা গেছে, নতুন নকশা অনুযায়ী পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের মূল সেতুতে মোট ২৯৪টি পাইল রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে ২৪৭টি পাইল বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৪৭টি পাইলের মধ্যে ১৫টি পাইলের অর্ধেক বসানো হয়ে গেছে। ২৯৪টি পাইলে থাকবে মোট ৪২টি খুঁটি। এসব খুঁটির ওপরে ৪১টি স্প্যান বসানো হবে। ৪২টি খুঁটির মধ্যে ২২টি খুঁটির নির্মাণ পুরোপুরি হয়ে গেছে। এই জুন মাসের মধ্যে ১০টি খুঁটির নির্মাণকাজ শেষ হয়ে যাবে।
২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিয়ারে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু। গত ২২ মার্চ পদ্মা সেতুর ৩৫ ও ৩৪ নম্বর পিয়ারের ওপর সবশেষ নবম স্প্যানটি বসানো হয়।
দ্রুতই বসবে আরও একাধিক স্প্যান
নয়টি স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর মোট ১ হাজার ৩৫০ মিটার দৃশ্যমান হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ১৩ ও ১৪ নম্বর পিয়ারের ওপর ১০ এপ্রিল একটি স্প্যান বসানো হবে। ২০ এপ্রিল জাজিরায় ৩৪ ও ৩৩ নম্বর আরও একটি স্প্যান বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে। চীন থেকে আসার পর ২১টি স্প্যানের বেশির ভাগই মাওয়ার কুমারভোগ কন্সট্রাকশন ইয়ার্ডে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। পিয়ার নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাকি স্প্যানগুলোর অংশও চীন থেকে প্রস্তুত করা হবে।
দ্রুত কাজ চলার কারণে ২০২০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে পদ্মা সেতুর কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমস্যা হলো পদ্মা নদীতে কোথাও দ্রুত পানি কমে যায়, কোথাও আবার দ্রুত পানি বেড়ে যায়। এ জন্য কাজে বিঘ্ন হচ্ছে। বার্জ মাউন্টেনগুলো চলাচল করতে সমস্যা হয়। তাই নদী ড্রেজিং করতে হচ্ছে। তবুও আশা করছি ১৫ মাসের মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণ শেষ করা যাবে।’
বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পটির যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সালে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওই বছরের ২৮ আগস্ট ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করে। পরে আওয়ামী লীগ সরকার এসে রেলপথ সংযুক্ত করে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে। প্রকল্পের বর্তমান ব্যয় ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
মূল সেতু নির্মাণের দায়িত্বে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। আর নদীশাসনের কাজ করছে চীনের আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন। দুই প্রান্তে টোল প্লাজা, সংযোগ সড়ক, অবকাঠামো নির্মাণ করছে দেশীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
সূত্র : প্রথম আলো