ছোট গল্প – শ্যামাঃ
হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম কোন এক রেলস্টেশনে, গন্তব্য কোন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাঁওতাল পোড়াবাড়ি দর্শন, হঠাৎ কোমল কন্ঠস্বর আমাকে চমকে দিয়ে বললো, আপনি এখানে আর আমি আপনাকে সেই কখন থেকে খুঁজছি। তার ডাকে আমাকে চমকে যেতে দেখে তার যেন চোখ কপালে উঠলো। আমাকে বলছে চলুন সামনে একটু এগুনো যাক। আমি বললাম, কোথায় যাবেন? তিনি বললেন চলুন না সামনে একটু দুরে ঘুরে আসি।
আমি বললাম, কিন্তু ট্রেন যদি ছেড়ে দেয় তখন? তিনি বললেন আরে দুর! আপনি এত বোকা কেন? ট্রেন ছাড়তে এখনও ৫/৭ ঘন্টা লাগবে। আমি বললাম, বলেন কি? কিন্তু কেন এত দেড়ি হবে। তিনি বললেন, আপনি কিছুই জানেন না? এটা তো রাজেন্দ্র পুর রেলস্টেশন। এখান থেকে ৪/৫ কিমি দুরে রেললাইন ভেঙে গেছে, দুর্বৃত্তরা এটা করছে। এবার আসুন আমার সাথে, আমি তখন বোকার মত বলে উঠলাম আচ্ছা আপনি কিছু খাবেন?
তিনি বললেন হঠাৎ খাবার কথা এলো যে! আমি বললাম, না মানে হয়েছে কি, আপনি তো বললেন দুরে যাবেন তাই কিছু খাবার নিয়ে গেলে কেমন হয়? তিনি বললেন, মন্দ হয় না, আচ্ছা আপনি আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসুন। আমি হা হয়ে বললাম, আপনি এত বড় মেয়ে চকলেট খান? তাতে তিনি কিঞ্চিত হাসলেন।
তারপর আমি পাশের দোকান থেকে কিছু চকলেট আর আইসক্রিম নিয়ে তার হাতে দিয়ে আপনমনে ঠাঁই দাড়িয়ে কিছু একটা ভাবছি – আমি বললাম আচ্ছা আপনাকে একটা কথা বললে কি খুব রাগ করবেন? তিনি আমাকে অভয় দিলেন, আচ্ছা আপনার ভেতর টা এত কোমল আর পবিত্র, তা আমার ভাবনাতেই ছিলো না।
তিনি বললেন, কি করে জানলেন? আমি বললাম, স্পর্শ করে। তিনি বললেন, কখন স্পর্শ করলেন? বললাম যখন ট্রেনের জানালার পাশে উদাস মনে আকাশ দেখছিলেন ঠিক তখন। তারপর কি ঘটলো? বললাম অনুভব করলাম আপনার ভেতরটা বেশ নরম আর বৈচিত্র্যময়।
মূদু হেসে তিনি বললেন, কেমন বৈচিত্র্যময়? বললাম, আপনাকে যে কদিন হলো চিনি ভেবেছিলাম আপনি অনেক রাগী আর অহংকারী মেয়ে, কিন্তু নাহ, আপনি যখন ট্রেনের জানালার পাশে বসে আকাশ পাণে তাকিয়ে ছিলেন আর আপনার মেঘ কালো চুলগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছিল, তখন আপনাকে অপরুপ সুন্দরী লাগছিলো। এককথায় অসাধারণ অনন্য রূপবতী।
হঠাৎ কেউ একজন চিৎকার করে বলছে, কি হচ্ছে এ সব? গোপনে গোপনে এই কর্ম হচ্ছে! আমাকে রেখে দুজনে চকলেট আর আইসক্রিম খাওয়া হচ্ছে। ভালো ভালো চালিয়ে যাও মিতা আপু।
সরি ভাইয়া কিছু মনে করবেন না, জানেনই তো মিনু একটু বেশি কথা বলে, আচ্ছা মিনু তুই এই চকলেট আর আইসক্রিম নিয়ে যা, সব তোর আমরা একটু সামনে ঘুরে আসি। মিনু বলছে, আমি তোমাদের সাথে যাবো। মিতা বললো, মিনু বেশি আদরে মাথায় উঠেছিস, সবসময়ই বড়দের সাথে থাকতে হবে না। মিনু বললো, আমি কি আর ছোট আছি নাকি। এখন কলেজে পড়ি। মিতা বললো, ঠিক আছে অনেক বড় হইছিস বুড়ি এখন যা।
মিনু এবার রেগেমেগে ফায়ার, আমাকে কথায় কথায় বুড়ি বলবা না মিতা আপু আমি কি বুড়ি হইছি। আমি তোমার চেয়ে সুন্দরী তাই হিংসা করো, বলেই রেগেমেগে এলোপাতাড়ি চকলেট ছুড়ে মেরে চলে গেলো। আমি মিতাকে বললাম, এভাবে মেয়েটাকে রাগানো কি ঠিক হলো? এবার মিতা রেগে বললো, আর একটা সুন্দরী মেয়ে সাথে থাকলে কি আপনার বেশি সুবিধা হয়, আমি বললাম এভাবে বলছেন কেন মিতা?
আর কিছু না বলে আমি অনেকটা সামনে এগিয়ে গেলাম। অনেক দুর এগিয়ে যাবার পর দেখলাম অনেক সুন্দর বুনোফুল ফুটে আছে, আমি বুনোফুল গুলো দুই হাতে স্পর্শ করছি, আর ভাবছি এমন সুন্দর বুনোফুল যদি কারো খোঁপায় পরিয়ে দিতে পারতাম, কতই না ভালো লাগতো।
হঠাৎ পিছন থেকে মিতা বলে উঠলো, বুনোফুল গুলো কি কারো খোঁপায় গুঁজে দিতে ইচ্ছে করে না আপনার? আমি বললাম, দিতে তো ইচ্ছে করেই, কিন্তু কে নেবে আমার হাতের ফুল বলুন? মিতা বলছে, আপনার হাতে থেকে কেউ ফুল নেবে কিনা জানি না, কিন্তু এমন সুন্দর বুনোফুল যে আমার খোঁপায় পড়তে ইচ্ছে করছে সেটাই বলছি। আমি পরম মমতায় বুনোফুল গুলো মিতার খোঁপায় গুজে দিলাম। আর মিতা অপলক দৃষ্টিতে বড্ড মায়া করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ঠাঁই দাড়িয়ে থেকে তার ভেতরের জমানো হাজারো না বলা কথা গুলো বলে দিল চোখের ইশারায়।
হঠাৎ বলে বসলো শোয়েব আজকের দিনটা মনে রাখবে তো, আমি নিজের অজান্তেই মিতার চোখ থেকে নিজেকে সড়িয়ে নিলাম। বললাম চলুন সামনে যাওয়া যাক, মিতা আমার হাতটা ধরে বললো, এখানটায় একটু বসো না। দেখনা সামনের বিলের পানির উপর থেকে কি সুন্দর শীতল হাওয়া বইছে। তারপর আমরা পাশাপাশি বসে হাওয়া খেতে বসলাম, কখন যে মিতা আমার বাঁ কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি।
অনেকক্ষণ সময় পার হবার পর আমি মিতার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। তারপর মিতা চোখ মেলে তাকালো, আমি মিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বললাম, মিতা এবার উঠুন অনেক সময় হয়ে গেছে ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এলো। তখন মিতা আচমকা উঠে বললো, ক্ষমা করবেন শোয়েব ভাই আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম। ঢাকার বাইরে এসে এমন সুন্দর প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারিনি, আপনার জন্য আজ পেলাম। আপনার কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞতা থাকবো। আর হৃদয়ে লালন করবো আজকের এমন নির্মল আনন্দের সুখের সৃতি, হয়তো আর কখন আপনার সাথে এমন সুখের অভিজ্ঞতা হবে না। তারপর আমরা টেনে উঠতেই ট্রেন আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্য ছেড়ে দিলো।
…………,,, এরপর টেন চলতে চলতে কেটে গেলো তিরিশ বছর! কাকতালীয় ভাবে আমি আবার নিজেকে আবিষ্কার করলাম সেই রাজেন্দ্র পুর রেলস্টেশনের সেই নির্জন বাগানে, হাতে সিগারেটের ধোঁয়ায় আছন্ন হয়ে ফিরে গেছি তিরিশ বছর আগের সেই দিনটা তে।
হঠাৎ পিছন থেকে কোমল কন্ঠে কেউ বলছে, যার জন্য জীবনের প্রত্যেকটা গল্প, কবিতা, উপন্যাস লিখেছেন মনের ভেতর জমিয়ে রাখা সমস্ত অনুভূতি দিয়ে আজ সেই মেয়েটি আপনার বাস্তব জীবনে নেই, নেই এতটুকুও জায়গা তার জন্য। আর একটু অধিকার টুকুনও দেন নি কখনো তাকে, আজ তার জন্য সাঁঝের বেলায় এসে আফসোস হচ্ছে কি কবি মশাই?
আমি হঠাৎ নিজেকে ফিরে পেলাম, আমি এতক্ষণ কার সাথে কথা বলছি, আমি পিছনে ফিরে বললাম, কে আপনি? আর কেন আমাকে এ সব বলছেন? ভদ্র মহিলা বললেন, আমি মিতা হক। আমি বললাম মিতা হক? কোন মিতা হক?
ভদ্র মহিলা বললেন, আপনি ক’টা মিতা হক কে চিনেন, কবি মশাই? আমি বললাম, না মানে হয়েছে টা কি, এই বুড়ো বয়সে তেমন কাউকে মনে রাখতে পারি এই আর কি। ভদ্র মহিলা বললেন, চশমা টা চোখে লাগিয়ে দেখুন, তিরিশ বছর আগে ঠিক এখানেই যাকে নিয়ে ভালোবাসার বীজ বুনেছিলেন মনের অজান্তেই। আমি সেই মিতা হক। যে আপনার কবি সত্তা কে পূর্ণরূপ দিয়েছে তাকে চিনতে পারছেন না?
আমি বললাম, আসলে আমি কি স্বপ্ন দেখছি? নাকি হ্যালোছিলেশানে আছি। মিতা বললো, তবে আমার হাতে চিমটি কেটে দেখুন।
আমি বললাম, আরে নাহ তার দরকার হবে না। আপনি কেমন আছেন? এখানে কি করে এলেন। মিতা বলছে, একটা করে উত্তর দেই। আমাকে চিমটি কাটতে যে সাহস লাগে তা কি আপনার কখনো জন্মে ছিলো? তখনই পারেন নাই, আর এখন বুড়ো হয়েছেন।
যাহোক, আমি সিলেটে যাচ্ছি বড় মেয়ের কাছে। মেয়েটা সিলেট মেডিকেলে কলেজে পড়ছে তাকে দেখতে যাচ্ছি। আজ হঠাৎ ট্রেন বিরতি দিলো তাই নেমে গেলাম। নিজের অজান্তেই এখানে চলে এসেছি, কিন্তু আপনাকে যে এভাবে পাব ভাবিনি।
আমি বললাম, ও! আচ্ছা চকলেট খাবেন, অবাক হয়ে বললেন, আপনার মনে আছে কবি মশাই। আমি বললাম, হুম মনে আছে তো, তখন আমিও চট করে কিছু চকলেট আর আইসক্রিম নিয়ে এসে মিতার হাতে দিতেই আর একটা কিশোরীর হাত আমার হাত থেকে চকলেট আর আইসক্রিম নিয়ে গেলো। ছোট্ট একটা মেয়ে ঠিক অপ্সরী মত।
তখন মিতা বললেন মেয়েটা কে জানেন? আমি বললাম, না তো! কখনো দেখিইনি। ও আপনার মিনুর ছোট মেয়ে আমার কাছেই থাকে। মিনু কেমন আছে? আর আমার মিনু কেন বলছেন?
মিতা বলছে, আপনার দেখছি এক সাথে দুটা প্রশ্ন করার অভ্যস যায়নি। আপনার মিনু এই জন্য বলছি যে আপনার জন্য আমার একমাত্র আদরের বোনটা দেশ ছেড়েছে। আচ্ছা সত্যি বলবেন আপনি কেন বারবার মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন?
আমি বললাম, কেন আপনি জানেন না। আমি তো তাকে ছোট বোনের মত দেখেছি, তাছাড়া ও তখন মাত্র কলেজে পড়ছিল।
মিতা বললো, হাঁ সত্যি বলার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। মিনু আপনার উপর অভিমান করে তার এক বন্ধু কে বিয়ে করে কানাডা চলে গেছে। ও হাঁ পড়াশোনা শেষ করেই গেছে আপনার জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করেছে। আপনি তাকে বারবার ফিরিয়ে দিয়েছেন অথচ মিনুর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন কেন?
আমি বললাম, সব কেন এর উত্তর আমার জানা নাই। মিতা বললো, তাহলে আমিই বলছি, আপনি তো কোনকালেই সাহসী ছিলেন না। মিনু বিয়ে করে দেশ ছেড়ে যাবার আগে আমাকে সবই বলে গেছে। আপনি শুধু মাত্র মিনুর সাথে যোগাযোগ করতেন আমার খোঁজ খবর নেবার জন্য। অথচ আমার সাথে যোগাযোগ করতে ভয় পেতেন। কেন?
আমি তখন ফ্যালফ্যাল করে মিতার দিকে তাকিয়ে আছি। তখনও মিতা বলেই চলছে, যে মিতাকে পাগলের মত ভালোবাসতেন তাকে একটাবার মুখ ফুটে সত্যিটা বলতে পারলেন নাহ? মিতা আমি তোমাকে ভালোবাসি মিনু কে নয়। অথচ আমি পাঁচ পাঁচ টি বছর আপনাকে জেনেছি আপনি স্বার্থপর মানুষ হিসেবে। কিন্তু মিনু যখন দেশ ছাড়ার আগে আমাকে সব সত্যিটা বলে গেলো ততদিনে আপনার ঠিকানা বদলে ফেলেছেন। তখন আমি আপনাকে পাগলের মত তন্নতন্ন করে খুঁজেছি পাইনি। অনেক বছর পর আপনার লেখা “মায়া” গল্পের বইটি হাতে পাই সাথে সাথে প্রকাশকের কাছে আপনার ঠিকানা নেবার চেষ্টা করেছি কিন্তু আপনি নাকি আপনার ঠিকানা দিতে নিষেধ করেছেন। আর বই প্রকাশ করেন ছদ্মনামে।
হঠাৎ পিছনে থেকে মিনুর মেয়েটা মিতার হাত ধরে টানতে লাগলো খালামুণি তাড়াতাড়ি চলো ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। মিতা কোন কথা আর বলার সুযোগ পেলো না, নিরবে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো। আমিও ঠাঁই দাড়িয়ে রইলাম। বারবার মনে হলো সেই তিরিশ বছর আগের মত যদি ট্রেনের লাইন ৬/৭ ঘন্টা নষ্ট হয়ে থাকত। তাহলে মিতা কে বলতে পারতাম সত্যি টা, কেন মিতা কে আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে সারাজীবন মিতাকে কষ্টে রাখতে চাই নি। তার চেয়ে বড় কারণ ছিলো মিতা যদি আমাকে ফিরিয়ে দিতো সেই আঘাত সইতে পারার সাহস আমার ছিলো না। কারণ মিতার পরিবারের সঙ্গে আমার পরিচয়ের কিছু দিন আগে আমি ডিভোর্সীর খাতায় নাম লিখেছি।
হঠাৎ করেই আমি এক মায়ার বাঁধনে আটকে পরে যাই, তার ঠিক চার দিনের মাথায় সেই মায়ার ময়না কে বিয়ে করি কিন্তু তার ক’দিন পরই আমার স্বপ্নের ঘর ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। জীবনের সব বিশ্বাস ভেঙে যায়। ভেঙে যায় কাউকে ভালোবাসা আর ভালো রাখার মনোবল, নিজেকে সবসময়ই খুব অপরাধী মনে হতো। আবারও কি একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করবো। তাই মিতা কে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে তার জীবনটা নষ্ট করতে চাইনি। আর তাই হয়তো তিরিশ বছর পরও মিতা কে সত্যি বলতে পারলাম না!
মিতা আজও আমাকে অপরাধী করেই চলে গেলো। আর আমাকে কখনো ক্ষমা করো না মিতা হক! ততক্ষনে আমার হাতের সিগারেটের আগুনে হাত পুড়ে ঝলসে গেছে টেরই পাইনি।