দেশের হস্তচালিত তাঁতিদের দুর্দিন চলছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলার গৃহস্থালি ও শিল্পকারখানার ঐতিহ্যবাহী তাঁতগুলো। নিরুপায় তাঁতিরা পেশা পরিবর্তন করছেন। সরকারি এক হিসাবে উঠে এসেছে, গত তিন দশকে অর্ধেক তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে এবং তাঁতির সংখ্যা ১০ লাখ থেকে ৩ লাখে নেমে এসেছে। এদিকে মাত্র ১৫ বছরে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের ৯৫ শতাংশ হস্তচালিত তাঁত কারখানা।
একসময় নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ তাঁতশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ হলে এখন দেশের হস্তচালিত শিল্পটি বেঁচে আছে পার্বত্য তিন জেলায়। এই তিন জেলায় আছে দেশের অর্ধেকের বেশি তাঁত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হস্তচালিত তাঁতশুমারি ২০১৮–এর প্রাথমিক ফলাফলে এই চিত্র উঠে এসেছে। শিগগিরই প্রতিবেদনের তথ্য প্রকাশ করা হবে। তাঁত বন্ধ হয়ে যাওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে ওই শুমারিতে। অন্যতম কারণ হলো অন্য পেশায় বেশি আয়, তাই অনেক তাঁতি পেশা পরিবর্তন করেছেন। এ ছাড়া অনেকেই যন্ত্রচালিত তাঁতে নিজেদের ব্যবসা স্থানান্তর করেছেন। অন্যদিকে মূলধনের অভাবেও তাঁত বন্ধ হচ্ছে। এ ছাড়া তাঁতপণ্যের বিক্রির জন্য শক্তিশালী বাজারজাত ব্যবস্থা নেই।
এবারের তাঁতশুমারিতে গৃহস্থালির তাঁতে কমপক্ষে গড়ে ২ দশমিক ৩ সংখ্যায় এবং কারখানায় ৯ দশমিক ২ সংখ্যায় তাঁতযন্ত্র আছে, তাদের মধ্যে শুমারি করা হয়েছে। বিবিএসের এই শুমারির সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাজারজাতকরণে সমস্যা এবং পেশা পরিবর্তনের কারণেই তাঁতের সংখ্যা কমেছে।
এ নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক রুশিদান ইসলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কিছু কিছু তাঁত স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তিতে চলে গেছে। ফলে হস্তচালিত তাঁত ও তাঁতির সংখ্যা কমেছে। এ ছাড়া তাঁতের কাপড়ের চাহিদাও কমেছে। মানুষের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা আরও মিহি বুননের কাপড়ের দিকে ঝুঁকছেন।
রুশিদান ইসলাম রহমান মনে করেন, প্রযুক্তির উন্নয়ন করে সবকিছু করা সম্ভব, কিন্তু দেশের ঐতিহ্যও ধরে রাখতে হবে। তাঁতশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে। সে জন্য হস্তচালিত তাঁতিদের জন্য নতুন নতুন নকশার পাশাপাশি পণ্যের বাজারজাতকরণের সহযোগিতা দিতে হবে।
বিবিএসের শুমারি অনুযায়ী, ১৯৯০ সালে সারা দেশে ১০ লাখ ২৭ হাজার ৪০৭ জন তাঁতি ছিলেন। পরের ১৩ বছরে তাঁতির সংখ্যা কমেছে ১ লাখ ২৫ হাজার। কিন্তু এরপরের ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি প্রায় ছয় লাখ তাঁতি নিজেদের পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। ২০১৮ সাল শেষে দেখা গেছে, দেশে হস্তচালিত তাঁত পেশায় আছেন মাত্র ৩ লাখ ১ হাজার ৭৫৭ জন। আবার গত তিন দশকে তাঁত বন্ধ হয়েছে প্রায় ৯৬ হাজার। এখন সারা দেশে তাঁতের সংখ্যা ১ লাখ ১৬ হাজার ৬টি।
সমতলে হারাচ্ছে, পাহাড়ে টিকে আছে
একসময় ঐতিহ্যবাহী হস্তচালিত তাঁতের জন্য বিখ্যাত ছিল নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইলের মতো জেলাগুলো। এই জেলাগুলো প্রসিদ্ধ ছিল তাঁতের জন্য। এসব জেলা সেই ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারছে না। সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে পার্বত্য তিন জেলা। রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে দেশের এখন ৫৫ শতাংশ তাঁত আছে। এসব জেলায় দেশের এক-তৃতীয়াংশ বা ৯৪ হাজার ১৯৭ জন হস্তচালিত তাঁতি আছেন।
শুমারির তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৯২ শতাংশ বা ১ লাখ ৭ হাজারের মতো তাঁত আছে মাত্র ১৫টি জেলায়। এর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী জেলা হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জে আছে চার হাজার তাঁত। আর টাঙ্গাইলে ৩ হাজার ২৯০টি এবং নরসিংদীতে মাত্র ১ হাজার ১২৮টি তাঁত। এই তালিকায় ১৫ নম্বর স্থানে আছে নরসিংদী।
রাজধানীর পার্শ্ববর্তী জেলায় বড় শিল্পের উত্থানের কারণে ঐতিহ্যবাহী ছোট শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, নব্বইয়ের দশকে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে বড় ও মুনাফামুখী শিল্পের বিকাশ হতে থাকে। তখন তাঁতের মতো ছোট শিল্পগুলো দেশের আরও প্রান্তিক এলাকায় চলে যায়। নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে বড় শিল্পের বিকাশ ঘটায় শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। এতে তাঁতের মতো ঐতিহ্যবাহী শিল্পের শ্রমিকেরা পেশা পরিবর্তন করেছেন। তিনি মনে করেন, এসব ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে ধরে রাখতে সরকারের নীতিগত সহায়তাও পর্যাপ্ত ছিল না।
সূত্র : প্রথম আলো