নৃশংসতা এখন নিত্যকার। দুর্বৃত্তদের অরাজকতায় দুঃসহ সাধারণের জীবন। অমানুষদের দাপট আর অপকর্ম অসহনীয়। চারদিকে প্রতিনিয়ত নির্মমতা। একটির পর একটি হৃদয়বিদারক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে অমানুষগুলো। তাদের পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের বলি হচ্ছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে আদর্শে গড়া মানুষ গুলো। ধ্বংস হচ্ছে হাজার মানুষের স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষার। তিল তিল করে ঘরে তুলা সততা, বিশ্বস্ততা ও আদর্শের মৃত্যু হচ্ছে। একটির পর একটি মানবসৃষ্ট বিভৎসতা আক্রান্ত পরিবার বা ব্যক্তির উত্তরসূরীদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে তাদেরকেও প্রতিশোধপরায়ণ করে দিচ্ছে। জন্ম দিচ্ছে নতুন নতুন নৃশংসতার। ফলে এক পরিবার আরেক পরিবারের সাথে, এক পাড়া আরেক পাড়ার সাথে, এক সমাজ আরেক সমাজের সাথে দাঙ্গা ফ্যাসাদে জড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এতে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক তাজা প্রাণ, উজ্জ্বল সম্ভবনা।
বড় অপরাধ গুলোর আড়ালে ছোট ছোট অপরাধ এখন একটা সিস্টেমে পরিণত হচ্ছে। ফলে সৎ, স্বচ্ছ ও প্রতিবাদী মানুষগুলো দুর্বৃত্তদের টার্গেটে পরিণত হচ্ছে। কি অন্যায় ছিল দিনাজপুরের ঘোরাঘাট উপজেলার ইউএনও ওয়াহিদা খানমের? কি অপরাধ ছিল সিনহা মোঃ রাশেদ ( অবঃ) এর? কি অপরাধ ছিল মেধাবী শিক্ষার্থী আবরারের? কিসের বলি হলো নুসরাত? কেন হত্যা করা হলো ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয়, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়, ফয়সাল আরেফিন দীপনকে? কি অন্যায় করেছিল বরগুনার রিফাত শরীফ? মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে একটির পর একটি জঘন্য হত্যাকাণ্ড মানুষকে চরম বিভ্রান্ত করছে, ভাবিয়ে তুলছে প্রজন্মকে, প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছি আমরা – আসলেই কি আমরা সভ্য? সাম্প্রতিক ভূয়া তথ্যের উপর নির্ভর করে ব্যাপক ধর্মীয় সহিংসতায় নষ্ট হয়েছে সম্প্রীতি, সহাবস্থান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও রামুর ঘটনায় নিন্দিত ও তিরস্কৃত হয়েছি সারা বিশ্বে। বর্তমানে তুচ্ছ ঘটনায় হাটে-বাজারে, অলিতে-গলিতে, রাস্তা-ঘাটে, ঝোপঝাড়ে, মাঠে-ময়দানে, বনে-জঙ্গলে, বাড়ি-ঘরে খুন-গুম,ধর্ষণ, লুন্ঠন, অগ্নিকাণ্ড হরহামেশাই ঘটে যাচ্ছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড, সাংবাদিক সূবর্ণা নদী হত্যাকাণ্ড, কয়েকদিন পরপর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, শিক্ষক-শিক্ষার্থী খুন সহ অসংখ্য নৃশংসতা জাতি হিসেবে আমাদের চরমভাবে কলঙ্কিত করেছে।
বর্তমান সময়ে পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। ইয়াবা আসক্ত ঐশির হাতে পুলিশ কর্মকর্তা বাবা ও মাকে খুন, যশোরে মাদকাসক্ত ছেলের হাতে মা-বাবা খুন। ভাবা যায় – কত অসভ্য আর জানোয়ার হয়েছি আমরা? লক্ষ্য করুন টাঙ্গাইলের মধুপুরে এক পরিবারের ৪ জনকে খুন, গাজীপুরের শ্রীপুরে প্রবাসী এক পরিবারের ৪ জনকে গলাকেটে হত্যা, অমুক স্থানে জোড়া খুন, গ্যাং র্যাপ, ধর্ষণের পর হত্যা, প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা এমন খবর কিন্তু কমন আমাদের দেশে। পরবর্তীতে পুলিশি তদন্ত বা অনুসন্ধানে প্রায়ই খুনী হিসেবে তরুন যুবক-যুবতিদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়।
এখন প্রশ্ন আসে অজ্ঞতা, নিরক্ষরতা ও অধিক দারিদ্রতা কাটিয়ে উঠার পর এ ডিজিটাল যুগে এত বর্বরতা কেন?
আমার সামান্য অর্জিত জ্ঞান বলে পারিবারিকভাবে সঠিক মানবিক শিক্ষা না পাওয়া, প্রকৃত ধর্মজ্ঞানের অভাব, অতি আদর, ছেলেমেয়েদের অন্যদের সাথে মিশতে না দেওয়া, শিশুকাল থেকে নৈতিক শিক্ষা না দেওয়া, একক পরিবারে শিশুদের কোনঠাসা করে রাখা, সামাজিক সম্প্রীতির অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক শাসন উঠিয়ে দেওয়া, অতি আহ্লাদে দামী দামী মোবাইল, ল্যাপটপ, মোটরসাইকেল কিনে দেওয়া, অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব, ছোট অপরাধ গুলোকে পাত্তা না দেওয়া, শিশুদের সামনে নিজেকে বাহাদুর হিসেবে জাহির করা, শিশুদের মতামতের প্রাধান্য না দেওয়া, সমাজপতিদের পক্ষপাতিত্ব, নেতা-নেত্রীদের অপরাধীদের আশ্রয়, পশ্রয় ও আইনী সহযোগিতা দান, ইয়াবা ও অন্যান্য মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা, শিশুদের সামনে পিতা-মাতার ঝগড়া-বিবাদ, পারিবারিক কলহ, সন্তানকে সন্দেহের চোখে রাখা, কোন দাবি পূরণ না করা, সবসময় তার সাথে খারাপ আচরণ করা।
জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বাস্তবমুখী পরিবর্তন আনে সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা। এই সংস্কৃতি মানুষকে মানবিক ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে। তাছাড়া শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ ও প্রকৃত জীবন গঠনে সংস্কৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। অনেক পিতা মাতা শিশুর আচরণ না বুঝে ২/৩ জন প্রাইভেট টিউটর ও একগাদা বইয়ের মাঝে শিশুকে নিযুক্ত রাখে। পরবর্তীকালে শিক্ষিত হলেও ঐ শিশুটি অসামাজিক ও বর্বর প্রকৃতির হয়।
পারিবারিক কলহ থেকে শত্রুতা, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস, ঘৃণা, প্রতিশোধস্পৃহা প্রবল করে যা তাকে বিপদগামী, উচ্ছৃঙ্খল ও নেশার জগতে প্রবেশ করায়। একপর্যায়ে ইয়াবা, মদ এসব গ্রহণের মাধ্যমে মনুষ্যত্ব ও বিবেকহীন পশুতে পরিণত হয়। বন্ধু বা সহপাঠীরা এ পথে প্রবেশ করতে উৎসাহ যোগায়। অনেক ক্ষেত্রে সবকিছু বুঝেও পিতা-মাতার নির্লিপ্ত ভূমিকা এদেরকে আরও অসভ্য করে তুলছে।
নৈতিকতা ও মানবিকতার কত অধঃপতন হলে নীলা রায়কে ধর্ষণের পর হত্যা করা যায় !! সিলেটে বড় বোন তুল্য একই কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীকে কয়েকটা মানুষরূপী, রাজনৈতিক মুখোশ পড়া হায়েনাদের হাতে স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষিত হতে হয় ! গ্যাং র্যাপের শিকার হতে হয় আদিবাসী বোনকে !!
এইসবতো গেল প্রকাশিত পাশবিকতার কয়েকটি উদাহরণ। আমাদের দেশে হরহামেশাই অপ্রকাশিত হাজারো জঘন্য অপরাধ ঘটছে প্রতিনিয়ত। লোকলজ্জা আর ভবিষ্যতের চিন্তা করে সেগুলো অপ্রকাশিতই থেকে যাচ্ছে আজীবন।
আর বিচারহীনতার সুযোগ নিয়ে মানুষরুপী জানোয়ারের দল নবউদ্যমে নতুন নতুন অপরাধ ঘটিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। তাই অমানুষদের দাপটে মনুষ্যত্ব নির্বাসনে।
লেখক –
প্রদীপ কুমার দেবনাথ,
শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।
(বিঃদ্রঃ মুক্তমতামতের জন্য সম্পাদক কোনভাবে দায়ী নন। )