প্রদীপ কুমার দেবনাথ,
নাসিরনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
সু – প্রাচীন কাল থেকেই সখ্যতা, বন্ধুত্ব, আথিতেয়তা ও আন্তরিকতার জন্য বাঙ্গালির পরিচিতি সারাবিশ্বে। প্রতিবেশীদের সাথে ঘনিষ্ঠতা নতুন কিছু নয়। বছরের প্রতিটি দিন একজনের উঠোনে অন্যজনের পদচারণা, বিশেষ করে বিকেল বেলা এবাড়ি ওবাড়ি করে যুবতী ও মধ্যবয়সী মেয়েদের ঘুরাফেরা, হৈ হুল্লোড়। আর উৎসব, অনুষ্ঠান হলেতো কথাই নেই। শাড়ি, নতুন জামা কাপড়, ছেলেরা পাঞ্জাবি, নতুন শার্ট, প্যান্ট পরে এ বাড়ি ও বাড়ি, রাস্তা, খেলার মাঠসহ প্রত্যেকটা জায়গায় দলবেঁধে অবাধ বিচরণ করতাম । উৎসব বাদে মাঠে চলত ফুটবল – ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি কখনো বা খুনসুটি। আবার মহুর্তেই অভিমান ভেঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যেত। তখন পশুত্ব ছিলনা কারণ মনুষ্যত্ব, বিবেক আর আবেগ ছিল ঐক্য গড়ার মূল চাবিকাঠি। স্কুল – কলেজের ক্রিড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে চলত তুমুল প্রতিযোগিতা।
বর্ষা এলে ছুটে যেতাম মাঠে, চলত হরেক রকম খেলার মহোৎসব। কলার ভেলা তৈরির প্রতিযোগিতা, জাল, বড়শি নিয়ে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা, আম কুড়ানোর প্রতিযোগিতা, ভাল দিনে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা।
সকল ব্যস্ততা শেষে বাড়ি ফিরে চলত কে কতক্ষণ সজাগ থেকে পড়তে পারে সে প্রতিযোগিতা, সকাল হলে কে আগে স্কুলে যাবে সে প্রতিযোগিতা, ক্লাসে চলতো স্যারকে খুশি করার জন্য কে কত সুন্দরভাবে পাঠ উপস্থাপন করতে পারে সে প্রতিযোগিতা, পরীক্ষা আসলে কত সুন্দর আর বড় করে যৌক্তিক ভাষায় উত্তর লেখা যায় তার প্রতিযোগিতা।
স্কুল ছুটি বা দু’তিন দিন ছুটি পেলে চলত ওয়ানডে, টেস্ট কিংবা ক্লাব ফুটবলের আদলে বিভিন্ন ম্যাচ।
সবসময় কান খাড়া থাকতো কোথায় নাটক বা বাউল গান হবে। তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করে খেয়েদেয়ে সারারাতের জন্য ৪/৫ টি টাকা নিয়ে ভালো একটা স্থানে বসে যেতাম সব বন্ধুরা মিলে। তবে এরজন্য প্রায় তিন/চারদিন প্রস্তুতি নিতাম।
ঈদ, পূজা বা সামাজিক অনুষ্ঠানে বন্ধুদের প্রস্তুতিই থাকতো ভিন্ন রকম। পাজামা – পাঞ্জাবি বা পাজামা – প্যান্ট হলেই দল বেঁধে বের হয়ে যেতাম উদ্দশ্যবিহীনভাবে। ঈদে মুসলমান বন্ধুদের বাড়িতে সেমাই, ফুল পিঠা, পাতা পিঠা, নকশী পিঠা, ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, মসলা পিঠা সহ কতরকম মিষ্টি পিঠা, মিষ্টিসহ অসংখ্য মুখরোচক খাবার খেতাম।
আবার পূজাতেও তাই। বাহারি ফল, খিচুড়ি, পিঠা, দুধের তৈরি নাড়ু, নারকেলের নাড়ু, তিলের, মুড়ির নাড়ু সহ অসংখ্য মুখরোচক খাবার খেতাম। পরে সবাই হাঁটতে থাকতাম জঙ্গলের ভিতর গাছগাছালির মাঝ দিয়ে আঁকাবাঁকা সরু মাটির পথ দিয়ে, মনের অজান্তেই একজন গান ধরতাম অন্যরাও শরীক হতো। তখন একবারও ভাবতামনা কে কোন ধর্মের, কোন বর্ণের, কোন পরিবারের। ভাবতাম যদি রাতদিন সবাই একসঙ্গে থাকতে পারতাম।
মনে পড়ে স্কুল ছুটি হলে বাড়ির কাছে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়তাম সবাই। আবার বিশেষ দিনে সিনেমা দেখতেও অনেক সময় চলে যেতাম বন্ধুরা সবাই মিলে।
বাড়িতে মেহমান এলে অথবা কোথাও বেড়ানোর কথা শুনলে খুশিতে উতলা হয়ে যেতাম কখন যাবো, কিভাবে যাবো, কোন জামা পড়বো সবসময় মাথায় এটাই কাজ করতো। অবশেষে বেড়াতে গিয়ে সমবয়সী কাউকে পেলে স্কুলের কথা, বন্ধুদের কথা বাবা – মায়ের কথা বলতে বলতেই কেটে যেত মধুর সেই দিনগুলো।
নবম – দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন মাথা উঁচু করে শ্রেণিকক্ষে ইচ্ছে থাকলেও একটা মেয়ের দিকে তাকাতাম না। অদৃশ্য এক লজ্জাবোধে নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম। শ্রেণিকক্ষে স্যারের পড়া দিতে গিয়ে হাজার সৃজনশীলতা প্রয়োগ করতাম।
আর আজকাল !!! কি চলছে আধুনিকতার নামে? সুস্থ সংস্কৃতির চর্চাই নেই কোথাও। নেই বৃষ্টিতে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, নেই খেলাধুলার চর্চা, নেই কলার ভেলা তৈরির প্রতিযোগিতা, রাতজেগে লেখাপড়ার প্রতিযোগিতা, নেই ক্লাসে পড়া দেওয়ার প্রতিযোগিতা, কোথাও নেই আম কুড়ানো, ঘুড়ি ওড়ানো, মাছ ধরার, ঈদে – পূজায় ঘুরবার, পানিতে সাঁতার কাটার, সাংস্কৃতিক বা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার, সবাই মিলে গ্রাম্য মেলা উপভোগ করার, আন্তরিকভাবে বন্ধুদের সাথে মেলার কোন চর্চাই নেই। কেমন যেন সব কিছু যন্ত্রের মতো হয়ে গেছে। আজকের ছোট বড় কারো মনে আনন্দ – উচ্ছ্বাস নেই। যেটুকু আছে খোলস মাত্র। আমরা অভিভাবকরাও তাদের ঘর থেকে বের হতে দেইনা। ফলে প্রাকৃতিক শিক্ষার ছোঁয়া কখনো তাদের শরীরে লাগেনা। আবদ্ধ ঘরে বসে প্রায়ই ইয়াবা, ফেনসিডিল বা অন্যান্য মরণনেশায় এরা আবদ্ধ। ছোট ছোট শিশুরা আই পি এল বা অন্য ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে জুয়া খেলছে। আর প্রেম – ভালবাসা তাদের কাছে ২০ টাকার একটি আইসক্রিমের মতো। যতক্ষণ আছে ততক্ষণ স্বাদ। অর্থাৎ যতক্ষণ দু’জন কাছে থাকবে ততক্ষণ বৈধ স্বামী-স্ত্রীরা যা করে, অবৈধভাবে রাস্তার ধারে, ফুটপাতে, হোটেলে, পার্কে, জঙ্গলে, গাড়ীতে চলে তাদের ব্যাপক নোংরামি। কাজ শেষ তাই তাদের ভালবাসাও শেষ। কি অদ্ভুত সংঙ্গা ভালবাসার !!! অর্থাৎ ভালবাসা মানে ফ্রিতে যৌননীলা।
বর্তমান ছেলেমেয়েদের অবস্থা মবিল, তেল বা গ্যাসে চালিত যানবাহনের মতো। স্টার্ট দিলে চলে অন্যথায় বন্ধ। নিজস্ব কোন স্পৃহা বা কিছু করার মতো মানসিকতা নেই। একা একা চলতে এবং অবসরে মোবাইল নিয়ে বসে থাকতে পছন্দ করে। অভিভাবকগণ রাতদিন সন্তানকে নিয়ে ব্যস্ত। তার সন্তান লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে, সমাজে দশজনের মধ্যে একজন নামকরা ব্যক্তি হবে, আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। কিন্তু কি হচ্ছে !!! হয়ত কেউ কেউ বলবেন আমার ছেলে অনার্স মাস্টার্স করেছে। কিন্তু লক্ষ্য করবেন তার কথাবার্তা, চলাফেরা আচার – আচরণে উগ্রতা ঠিকই বর্তমান। কিছুদিন আগে আমার এক প্রতিবেশী কাকার মুদির দোকানে বসেছি কিছু কেনার উদ্দেশ্যে। আমি উনার ছেলের কথা জিজ্ঞেস করতেই হাজার হাজার অলঙ্কার লাগিয়ে বিশেষ একজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত করানোর জোড় চেষ্টা চালালেন। অবশ্য সিলেট এম সি কলেজ থেকে সে এবার কোন বিষয়ে মাস্টার্স করেছে। একটু পরেই ছেলেটা হাজির। উনি বড় আশা করে পরিচয় দিলেন,” তোর মাস্টার আঙ্কেল। ঐ যে নাথ বাড়ির ইংরেজি স্যার প্রদীপ স্যার ছিলেন ওনি। খুব ভালো আর সম্মানিত মানুষ। মন্ত্রী সাব ওনাকে খুব পছন্দ করে।” আমার দিকে একটু চেয়ে শুকনা হাঁসিতে বলল, ” ও, আচ্ছা। ” সে কি যেন নিল আবার তার বাবার নিকট থেকে ঘুরতে যাবে বলে ১০০০ টাকা নিল। সে চলে গেলে উনি আবার বললেন, “খুব লাজুক”। আমি বিরক্ত হলেও কিছু না বলে সামান্য কিছু কেনাকাটা করে চলে এলাম। এখন ভাবুন যুগের সাথে আমরা অভিভাবকরাও কতটুকু অন্ধ হয়ে যাচ্ছি !! এত বর্ণনার পরেও ছেলেটা আমাকে একটু আদাব-নমস্কারও দিতে পারেনি। ভাববেননা পাঠক আমি এসব সালাম – আদাবের কাঙ্গাল !!! শুধু বাস্তবতা ফুটিয়ে তুললাম।
তাই আমার সাফ কথা সংস্কৃতি, সামাজিক প্রথা, আচার-আচরণ, সামাজিক রীতিনীতি মানলে সবদিক দিয়েই গুণবান – গুণবতী হওয়া যায়। কারণ, সংস্কৃতি একজন মানুষকে উদার হতে, ভালমনের হতে, সৃজনশীল হতে, বিশ্বাস করতে শেখায়। সংস্কৃতি একজন মানুষের জড়তা দূর করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজে মনোনিবেশ করতে সাহায্য করে। একটা দেশের সংস্কৃতি সেই দেশের প্রতিচ্ছবি। এই সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো মানুষের উগ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে নমনীয় ও প্রকৃত মানুষ রুপে গড়ে তুলা। এই বাস্তব সত্যটাই আজ বিলীনের পথে। অসুস্থ সংস্কৃতি ও মোবাইল ফোনের যত্রতত্র ব্যবহার শিক্ষার্থীদের উগ্র ও মৌলবাদী করে দিচ্ছে। মিথ্যা ও পক্ষপাতদুষ্ট ফেসবুক তাদেরকে নিষ্ঠুর, নির্মম করে নয়নবন্ড, রিফাত ফরাজি, সিফাত ফরাজি, মিন্নির মতো করে তুলছে।
ফলে মা – বাবা, শিক্ষক, মুরুব্বির প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ কমে শূন্যের কোটায় চলে যাচ্ছে। সমাজের শৃঙ্খলা পুরোপুরি ধ্বংসের পথে।
এহেন অবস্থা থেকে বের হতে না পারলে এই পৃথিবী থেকে মানবতা, নীতি নৈতিকতা, আদর্শ, বিবেকবোধ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হবে। তখন এই আধুনিক ডিজিটাল যুগটা চরম অবস্থায় পড়বে।
তাই মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার সীমিত করা এখন এক চরম বাস্তবতা। দেশকে জঙ্গিবাদ, অমানবিক ঘটনা থেকে বাঁচাতে সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চার বিকল্প নেই। আগের সেই বাউল, জারী, সাড়ি, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, নজরুল গীতি, রবীন্দ্র সংগীত ইত্যাদি গুরুত্ব সহকারে সরকারি পৃষ্ঠপোষতায় চালু করার উচিত। এসব গান, কবিতা ও শিক্ষণীয় গল্পে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে ইউনিয়ন পর্যায়ে থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করে উৎসাহিত করা উচিত।
নয়ত উঠতি বয়সের এসব তরুণ তরুণীদের ব্যবহার করে একটি মহল ধর্মীয় বিষবাষ্প ছড়িয়ে পুরো দেশটিকেই ধ্বংস করে দিবে। অবশ্য ইতিমধ্যেই কিছু কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
তাই আগামী প্রজন্মকে সঠিক ও প্রকৃত নাগরিক করে গড়ে তুলতে, অমানবিকতা দূর করতে ও আদর্শ মানুষ হিসেবে দেশের টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে বাজে সংস্কৃতি বন্ধ করে শালীন ও বাস্তবমুখী সংস্কৃতি চর্চা করার দরকার। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহল এবং সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের গর্বের ধন অতি আদরের সোনার বাংলায় সোনার মানুষ দরকার। আর তাই, আমাদের শেকড়ের সংস্কৃতি চর্চাই এ অবস্থা হতে উত্তরণের একমাত্র উপায়। কারণ সুষ্ঠ ও শালীন সংস্কৃতি প্রকৃত মানুষ, ভিতরের প্রতিভা ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলার নিয়ামক।
প্রদীপ কুমার দেবনাথ,
সহকারী প্রধান শিক্ষক,
ফান্দাউক পন্ডিতরাম উচ্চ বিদ্যালয়
এবং লেখক ও সাংবাদিক,
নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।