মোঃ সদরুল কাদির (শাওন), সাতক্ষীরা :: অপারেশন থিয়েটারে তুলে উচ্চ রক্তচাপ কমানোর ভুল ইনজেকশন দেওয়ায় এক অন্তঃস্বত্বা শিক্ষিকার মৃত্যু হয়েছে। বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে মৃত্যুর চার ঘন্টা পর এম্বুলেন্স এনে সাতক্ষীরায় পাঠানোর চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় মৃতের স্বজনরা।
রোববার রাত আটটার দিকে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা আহছানিয়া মিশন চক্ষু ও জেনারেল হাসাপাতাল এণ্ড ডায়াগনেষ্টিক সেন্টারে এ ঘটনা ঘটে।
অভিযোগ বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে নাশকতার মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে থানায় কোন অভিযোগ ছাড়াই লাশ বাড়িতে নিয়ে ময়না তদন্ত ছাড়াই দাফন করতে বাধ্য করা হয়।
মৃতের নাম ফতেমা তুজ জোহরা ওরফে চামেলী (৩০)। তিনি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বড়কুপট গ্রামের ব্যাংক কর্মী ফজলুল হক আকাশের স্ত্রী ও খুলনার শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পূর্ণবাসন কেন্দ্রের শিক্ষক।
জনতা ব্যাংকের শ্যামনগর শাখার কোষাধ্যক্ষ ফজলুল হক আকাশ জানান, তার স্ত্রী তিন বছর ধরে খুলনার শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পূর্ণবাসন কেন্দ্রের শিক্ষক। তিনিও সম্প্রতি খুলনা থেকে শ্যামনগরে বদলী হয়ে এসেছেন। তাদের চার বছরের একটি পুত্র সন্তান রয়েছে।
দ্বিতীয় পুত্র সন্তান ডেলিভারির জন্য তার স্ত্রী চামেলীকে শনিবার সকালে খুলনা থেকে তার বাপের বাড়ি কালিগঞ্জের নলতা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক লিয়াকত আলীর বাড়িতে আনা হয়। চাচা শ্বশুর আব্দুল মান্নান মিস্ত্রী রোববার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে চামেলীকে নলতা আহছানিয়া মিশন চক্ষু ও জেনারেল হাসাপাতাল এণ্ড ডায়াগনেষ্টিক সেন্টারে ভর্তি করেন।
চামেলীর সিজারের জন্য হাসপাতালের ব্যবস্থাপক শামীম হোসেন ও কোষাধ্যক্ষ এবাদুল ইসলামকে ৯ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
ফজলুল হক আকাশ আরো জানান, রোববার বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে চামেলীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একজন নার্স এনেসথেসিয়া হিসেবে ইনজেকশন দিলে চামেলীর শরীরে উচ্চ রক্ত চাপ দেখা দেয়।
সংশ্লিষ্ট কোষাধ্যক্ষ এবাদুল হক বিষয়টি ডাঃ আকছেদুর রহমানকে জানালে তিনি একটি ইনজেকশন দিয়ে উচ্চ রক্তচাপ কমানোর পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ি ইনজেকশন দেওয়ার পর ডাঃ আকছেদুর রহমান অপারেশন থিয়েটারে আসেন। বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে সিজার করার আগেই চামেলী মারা যায়।
চামেলীর বাবা শুইলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক লিয়াকত আলী, তার ভাই মান্নান মিস্ত্রী, চামেলীর ফুফাত ভাই সরফুদ্দিন জানান, চামেলীর সিজার হলো কিনা তা জানার জন্য বার বার চেষ্টা করা হলে তাদেরকে জানানো হচ্ছিল না।
একপর্যায়ে রাত ৮টা ১০মিনিটে ডাঃ আকছেদুর রহমান, নলতা আহছানিয়া মিশন চক্ষু ও জেনারেল হাসাপাতাল এণ্ড ডায়াগনেষ্টিক সেন্টারের ব্যবস্থাপক শামীম হোসেন, কোষাধ্যক্ষ এবাদুল ইসলাম নলতা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের এম্বুলেন্স ডেকে অপারেশন থিয়েটার থেকে খালি গায়ে এনে চামেলীকে সাতক্ষীরায় নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেন।
এ সময় চামেলীর সার্বিক অবস্থা না জেনে এম্বুলেন্সে তোলা যাবে না মর্মে স্বজনরা বাধা দিলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধ বাঁধে। এ সময় চামেলী মারা গেছে মর্মে জানতে পেরে কালিগঞ্জ থানায় খবর দেন। অবস্থা বেগতিক বুঝে সাবেক ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা আনিছুজ্জামান খোকন ছুটে আসেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা এবাদুল ইসলাম ও আওয়ামী লীগ নেতা আনিছুজ্জামান খোকনসহ কয়েকজন তাদেরকে (চামেলীর স্বজন) এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি না করে লাশ মাটি দেওয়ার হুমকি দেন।
থানা পুলিশ করলে ভাল হবে না জানিয়ে তারা বলেন, নাশকতার মামলা খাওয়ার সাধ থাকলে পুলিশ ডাকেন। একপর্যায়ে কালিগঞ্জ হাসপাতাল থেকে অবসরপ্রাপ্ত ডাঃ আকছেদুর রহমান কার্ডিয়াক হার্ট এটাকে চামেলী রোববার রাত সাতটায় মারা গেছে মর্মে মৃত্যু সনদ লিখে দেন।
মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের বাচ্চু মৃধা এম্বুলেন্সে করে রাত ১১টার দিকে চামেলীর লাশ তার বাপের বাড়িতে রেখে আসেন। সোমবার দুপুরে নামাজে জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে চামেলীর লাশ দাফন করা হয়। তারা গর্ভস্ত সন্তানসহ চামেলী হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
নলতা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের এম্বুলেন্স চালক বাচ্চু মৃধা জানান, নলতা আহছানিয়া মিশন চক্ষু ও জেনারেল হাসাপাতালের কোষাধ্যক এবাদুল হকের ফোন পেয়ে তিনি রোববার রাত ৮টার দিকে এম্বুলেন্স নিয়ে রোগী সাতক্ষীরায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আসেন।
সেখানে ডাঃ আকছেদুর রহমান ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চামেলীর স্বজনদের বচসা হয়। চামেলী মারা গেছে জানার পর পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়। একপর্যায়ে রাত ১১টার দিকে তিনি চামেলীর মৃতদেহ তার বাপের বাড়িতে রেখে আসেন।
সোমবার বিকেল ৪ টায় ডাঃ আকছেদুর রহমানের সঙ্গে তার ০১৭১২-২১৬৯১৫ নং মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
নলতা আহছানিয়া মিশন চক্ষু ও জেনারেল হাসাপাতাল এণ্ড ডায়াগনেষ্টিক সেন্টারের কোষাধ্যক এবাদুল ইসলামের সঙ্গে সোমবার বিকেল সোয়া চারটায় তার ০১৭১৬-৩৭২৩৫৫ নং মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি তা রিসিভ করেননি। মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায় হাসপাতালের ব্যবস্থাপক শামীম হোসেনের।
নলতা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক ইউপি সদস্য আনিছুজ্জামানের সঙ্গে সোমবার বিকেল সাড়ে চারটায় তার ০১৭১৪-০২৮০০৯ নং মোবাইল ফানে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি রিসিভ করেননি।
কালিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাসান হাফিজুর রহমান জানান, সোমবার বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত এ নিয়ে থানায় কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।