নিয়ম ভেঙে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন বাবদ বিভিন্ন অনলাইন প্রতিষ্ঠান বড় অংকের অর্থ ব্যয় করছে বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এর মাধ্যমে বড় অংকের অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে বলে মনে করছে সংস্থাটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি না নিয়ে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেয়ায় সম্প্রতি ১০টি প্রতিষ্ঠানকে তলব করে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের মানি লন্ডারিং টিম। তলবে সাড়া দিয়ে গতকাল সিআইডির মালিবাগ কার্যালয়ে হাজির হন পিকাবু, আজকের ডিল, বিক্রয় ডটকম, চালডাল ডটকম, দারাজ ডটকম, ফুডপান্ডা, খাশফুড, অথবা ডটকম, রকমারি ও সেবা ডট এক্সওয়াইজেডের প্রতিনিধিরা। যদিও তাদের দাবি, ফেসবুকে বিজ্ঞাপনের অর্থ তাদের বিদেশী অংশীজনরা পরিশোধ করেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অন্যতম এ প্ল্যাটফর্মে বাণিজ্যিকভাবে কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপন দেয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু অনেক অনলাইন প্রতিষ্ঠান তা মানছে না বলে জানান সিআইডির কর্মকর্তারা। সিআইডির অনুসন্ধান দলের এক কর্মকর্তা জানান, শুধু অনলাইনভিত্তিক এসব প্রতিষ্ঠানই নয়, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, সেলফোন বিক্রেতা ও টেলিকম খাতের কিছু প্রতিষ্ঠানও রয়েছে এ তালিকায়। তাদেরও তলব করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে ওইসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা সিআইডি কার্যালয়ে হাজির হবেন। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম আগেই জানাতে চাননি এ কর্মকর্তা।
সিআইডির তথ্যমতে, ই-কমার্স খাতের ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান প্রতি মাসে অন্তত ১ হাজার ডলার ফেসবুক বিজ্ঞাপন বাবদ ব্যয় করছে। আর বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ৮-১০ হাজার ডলার বিজ্ঞাপন বাবদ ফেসবুককে পরিশোধ করে। বিজ্ঞাপনের অর্থ পরিশোধ করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি বিধান রয়েছে। সেই বিধান অনুযায়ী ডুয়াল কারেন্সির ক্রেডিট কার্ড থেকে সার্কভুক্ত দেশে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ডলার আর সার্কের বাইরে সর্বোচ্চ ৭ হাজার ডলার খরচ করা যায়।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের মুখপাত্র মোল্যা নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ফেসবুকে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন দেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু কিছু অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, সেলফোন বিক্রেতা ও টেলিকম প্রতিষ্ঠান এসব নিয়মের তোয়াক্কা না করেই বিপুল অর্থ ব্যয় করে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, যা মানি লন্ডারিংয়ের মধ্যে পড়ে। প্রথমে আমরা ১০টি প্রতিষ্ঠানকে তলব করেছি। পর্যায়ক্রমে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ডাকা হবে।
অনুসন্ধানসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, প্রথম দিনে হাজির হওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনোটিই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি দেখাতে পারেনি। তারা বলেছে, বিদেশে তাদের ব্যবসার অংশীজন রয়েছেন। তারা সেখান থেকেই এসব বিজ্ঞাপন ফেসবুকে দিয়ে থাকেন। এমন জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে ওইসব প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের অংশীজনের বৈধ কাগজ ও বিজ্ঞাপনের বিল পরিশোধের কাগজ চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত, পেমেন্ট সিস্টেম ও বুস্টআপের সব তথ্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়েছে।
দেশের জনপ্রিয় অনলাইন শপ পিকাবু ডটকম। এর ওয়েবসাইট থেকে হ্যান্ডসেট, কম্পিউটার, টিভি, আসবাব ও রান্নাঘরের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনাকাটা করা যায় সহজে। সিআইডির তলবের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির চিফ অব প্রডাক্ট মরিন তালুকদার বলেন, প্রমোশনসের কিছু বিষয় জানার জন্য তলব করেছিল। তারা আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, পেমেন্ট সিস্টেম ও বুস্টআপের বিষয়ে জানতে চেয়েছে। একদিনের নোটিসে এত কিছু সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। আমরা বলেছি, দ্রুততম সময়ের মধ্যেই আমরা সব ডকুমেন্ট তাদের কাছে জমা দেব।
ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতির বিধান রয়েছে। সেই অনুমতিপত্র দেখাতে পেরেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমরা শুধু প্রডাক্টের অর্ডার নিই ও ডেলিভারি প্রদান করি। আর প্রমোশনের বিষয়টি বিদেশী অংশীজন দেখেন। ওনারা ওখান থেকে ফেসবুক বিজ্ঞাপনের অর্থ পরিশোধ করেন। এ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পরিশোধ করা হয় না বলেও জানান তিনি।
বিদেশী অংশীজনের অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রেও আপত্তি রয়েছে সিআইডির। সংস্থাটির ভাষ্যমতে, যেহেতু ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের ক্রেতাদের টার্গেট করে, তাই এ বিজ্ঞাপনের বিল বিদেশ থেকে পরিশোধের কোনো সুযোগ নেই। বিজ্ঞাপনের অর্থ দেশে এনে তারপর বৈধ পথে সরকারকে রাজস্ব পরিশোধ করে অর্থ বিদেশে পাঠাতে হবে। এর বাইরে গিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বিদেশী অংশীজনের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের অর্থ পরিশোধ করে, তবে সেটি হবে মানি লন্ডারিং।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের মানুষকে টার্গেট করে যে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়, সেটার জন্য কোনো নীতিমালা নেই। তবে বিজ্ঞাপন বাবদ যে টাকা ব্যয় করা হবে, তার জন্য অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নিতে হবে এবং সেটা পৃথকভাবেই নিতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি এ অনুমতি না নিয়ে বিজ্ঞাপনের টাকা পরিশোধ করে, তবে সেটা অবশ্যই মুদ্রা পাচারের অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
সিআইডির তলবে গতকাল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সেবা ডট এক্সওয়াইজেডের প্রতিনিধিও সংস্থাটির কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি একটি অন-ডিমান্ড সার্ভিস মার্কেটপ্লেস। এর অ্যাপ ও ওয়েবসাইট থেকে ১৫০ রকমের বেশি সেবা নেয়া যায়। দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সার্ভিস যেমন—ইলেকট্রিক্যাল সার্ভিস, প্লাম্বিং ও স্যানিটারি, বিউটি সার্ভিস, বাসা বদলসহ সব রকম সেবা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। সেই সঙ্গে অফিসের বিভিন্ন রকম সার্ভিস যেমন—ডিজিটাল সিকিউরিটি সার্ভিস, অফিস শিফট, লিফট অ্যান্ড জেনারেটর সার্ভিস, অফিস ক্লিনিং, আইটি অ্যান্ড গ্যাজেট সার্ভিসের জন্য সেবার অ্যাপেই অর্ডার করতে পারেন গ্রাহক। রয়েছে অন-ডিমান্ড ড্রাইভার খুঁজে নেয়ার সুবিধাও।
সেবা ডট এক্সওয়াইজেডের সিইও আদনান ইমতিয়াজ হালিম বণিক বার্তাকে বলেন, সিআইডি মূলত আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল, ফেসবুক বিজ্ঞাপন ও সার্ভার রক্ষণাবেক্ষণের খরচটা আমরা কীভাবে পরিশোধ করি। আমরা নিজেদের অবস্থান তাদের পরিষ্কার করেছি। আমরা মূলত ফেসবুক বিজ্ঞাপনের খরচটা একটি থার্ড পার্টির মাধ্যমে পরিশোধ করি। এ প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদিত। এজন্য আমি মনে করি, আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে মানি লন্ডারিংয়ের কোনো ঘটনা ঘটছে না।
সিআইডির তলবে সাড়া দিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অনলাইন মার্কেটপ্লেস দারাজ ডটকমও। এটি চীনের আলিবাবা গ্রুপ হোল্ডিং লিমিটেডের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। দারাজ ডটকমে মোবাইল ডিভাইস, ইলেকট্রনিকস ও ফ্যাশন পণ্য কেনা-বেচার সুবিধা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির হেড অব পিআর মিডিয়া অ্যান্ড প্ল্যানিং শাওন্তনি তিশা বলেন, সিআইডি আমাদেরসহ বেশকিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে ডেকেছিল। আমাদের বক্তব্যে তারা সন্তুষ্ট। আমাদের প্রতিষ্ঠান অবৈধ কোনো লেনদেন করে না।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন মার্কেটপ্লেস বিক্রয় ডটকম। এ সাইট থেকে নিকটবর্তী স্থান থেকে পুরনো গাড়ি, মোবাইল ফোন, নতুন কিংবা পুরনো বাড়িসহ সব ধরনের প্রোপার্টি ক্রয়-বিক্রয় করা যায়। প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশের হেড অব মার্কেটিং ও সেলস ইশিতা শারমিন বলেন, আমরা তিন বছর ধরে ফেসবুকে তেমন বুস্টআপ করিনি। যেহেতু আমাদের প্রতিষ্ঠান একটি মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠান, তাই মিনিমাম যে বুস্টআপ, সেটা আমাদের মূল অফিস থেকে করা হয়। যদি আমরা লাভে থাকতাম, তাহলে অবশ্যই বাংলাদেশ থেকেই বিজ্ঞাপনের বিল পরিশোধ করতাম।
সূত্র : নিউজ ২৪