পবিত্র রমজান হলো পাপ মোচন ও ক্ষমা লাভের মাস। বিশেষ করে শেষ ১০ রমজানে পাওয়া সময় হলো ইবাদতের সবচেয়ে গুরুত্ববহ ও আবেদনময় সময়। তবে দশক হিসেবে পবিত্র রমজানকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত। রমজানের প্রতিটি মুহূর্তই অতি মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। তবে শেষ দশকের গুরুত্ব বেশি হওয়ার কারণ হলো, এই অংশে রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তা হলো লাইলাতুল কদর, ইতিকাফ, জুমাতুল বিদা ও সাদাকায়ে ফিতর।
শেষ ১০ রমজানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইবাদত-বন্দেগি হতো বছরের অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এমনকি রমজানের প্রথম বিশদিন থেকেও আলাদা বোঝা যেত শেষ দশদিনের ইবাদত-নিমগ্নতা। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে এত বেশি ইবাদত করতেন, যা বছরের অন্য সময়ে করতেন না।’ (মুসলিম : ১১৭৫)। তিনি আরও বলেন, ‘যখন রমজানের শেষ দশক আসত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবাদতের জোর প্রস্তুতি নিতেন। নিজে রাত্রি জাগরণ করতেন। পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে তুলতেন।’ (বোখারি : ২০২৪)।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন।’ (বোখারি : ২০২৫)।
শেষ ১০ রমজানে রাসুল (সা.) কে অনুসরণ করে যেসব আমল করা উচিতঃ
১। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রমজানের শেষ দশকে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইবাদতের জন্য লুঙ্গি শক্ত করে বেঁধে ফেলতেন তথা ইবাদতের জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। সারা রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং স্বীয় পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)।
২। লাইলাতুন অর্থ রাত। কদরের এক অর্থ সম্মান, মর্যাদা, সুমহান। আরেক অর্থ তাকদির বা ভাগ্য নির্ধারণ। লাইলাতুল কদর অর্থ সম্মানিত রজনী বা ভাগ্য নির্ধারণের রজনী। এই রাত হাজার মাসের চেয়ে মর্যাদাবান এবং এই রাতে পরবর্তী এক বছরের ভাগ্য নির্ধারিত করা হয় বলে এই রাতকে লাইলাতুল কদর বলা হয়। মহানবী (সা.) এ রাত অনুসন্ধান করতেন এবং উম্মতকেও অনুসন্ধান করতে বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে, তোমরা রমজানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাতে শবেকদর তালাশ করো। (সহিহ বুখারি)। কদরের রজনীর নির্দিষ্ট বর্ণনা কোরআন ও হাদিসে নেই। ফলে রাতটি নির্ণয়ে ইমামদের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। কারো মতে কদর রমজানের ২১তম রাত, কারো মতে ২৩তম রাত, কেউ বলেন ২৫তম রাত, কেউ বলেন ২৯তম রাত। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে ২৭তম রাত।
৩। ইতিকাফ অর্থ অবস্থান করা, আটকে রাখা, নিজেকে বন্দি করা, মসজিদে অবস্থান করা ইত্যাদি। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ইবাদতের উদ্দেশ্যে রমজানের শেষ ১০ দিন মসজিদে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। ইতিকাফ রমজানের শেষ দশকের বিশেষ আমল। ভোগবাদী দুনিয়ার মিথ্যে মায়া ত্যাগ করে, পরিবার-পরিজন, চাকরিবাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি বর্জন করে কেবল মনিবের সন্তুষ্টির জন্য একান্তে বসে ইবাদত বন্দেগি করা উচ্চ মানসম্পন্ন মুমিনের পরিচয়। আয়েশা (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন, যে পর্যন্ত না আল্লাহ তাকে ওফাত দান করেন। তার পরে তার স্ত্রীরা এভাবে ইতিকাফ করতেন। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিবছর রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। যে বছর তাকে তুলে নেওয়া হয়, সে বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফ করেছিলেন। (সহিহ বুখারি)।
৪। সাদাকা অর্থ দান, জাকাত ইত্যাদি। আর ফিতর অর্থ ভঙ্গ করা, বিদীর্ণ করা, সৃষ্টি করা ইত্যাদি। উভয় শব্দের যৌথ অর্থ দানের মাধ্যমে ভঙ্গ করা। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়াল মাসের প্রথম দিন দান ও ঈদ উদ্যাপনের মাধ্যমে রোজা ভঙ্গ করা হয়, তাই এই দান সাদাকাতুল ফিতর এবং এই দিনকে ঈদুল ফিতর বলা হয়। ধনী স্বাধীন মুসলমান ব্যক্তির ওপর সাদাকায়ে ফিতর ওয়াজিব। মহানবী (সা.) রমজানে অধিক পরিমাণে দান করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, রমজানে রাসুল (সা.)-এর দান সদকা করার ব্যাপারে উৎসাহ উদ্দীপনা অধিক বেড়ে যেত। তিনি রমজান মাসকে শারুল মুয়াসাত তথা সহানুভূতির মাস বলে ঘোষণা করেন। সাদাকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয় দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) সাদাকায়ে ফিতর নির্ধারণ করেছেন রোজাকে অনর্থক ও অশালীন বাক্যালাপ থেকে পবিত্র করার জন্য এবং নিঃস্বদের খাদ্য দানের জন্য। (সুনানে আবি দাউদ)।
৫। মানুষের থেকে গোনাহ সংঘটিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় ওই বান্দা, যে গোনাহ হয়ে গেলে আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে এবং আর কখনও গোনাহ না করার দৃঢ় সংকল্প করে। এটাই প্রকৃত তওবা। তাই তওবার নিয়তে দু’রাকাত নামাজ পড়া উত্তম। পাশাপাশি আল্লাহর কাছে দোয়া করা চাই। জায়েদ (রা.) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন, যে ব্যক্তি এ দোয়া পড়ে, তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়; যদি সে রণক্ষেত্রও থেকে পলায়ন করে থাকে; দোয়াটি হচ্ছে—আসতাগফিরুল্লাহাল আজিম, আল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়ুল কাইয়ুমু ওয়া আতুবু ইলাইহি।অর্থাৎ মহান আল্লাহর কাছে আমি ক্ষমা চাই, যিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই; যিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী এবং আমি তাঁর কাছে তওবা করি। (তিরমিজি : ৩৫৭৭)।
পবিত্র রমজান মাসে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমার দুয়ার অবারিত করেন। রোজার বিনিময়ে বান্দার গোনাহ মাফ করেন। তারাবি আদায়ে মুছে দেন সব আবিলতা। অন্যকে সেহরি-ইফতারে শরিক করালে দেন ক্ষমার সঙ্গে অবারিত নেকি। তাই রমজানের প্রতিটি মুহূর্তই বরকতপূর্ণ ও ক্ষমা লাভের স্বর্ণ সময়।
আজ ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | হেমন্তকাল | ২১শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি | বিকাল ৫:২৮ | শনিবার
ডিবিএন/এসই/ এমআরবি