হুমায়ুন কবির, ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধিঃ ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনায় থানায় পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পুলিশের দুই সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) বাদী হয়ে মামলা তিনটি করেন। এতে অজ্ঞাতনামা ৬৫০ থেকে ৮০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
থানা– পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার (২৭ জুলাই) রাণীশংকৈল উপজেলায় তিনটি ইউনিয়নে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বাচোর ইউনিয়ন পরিষদের টেকিয়া মহেষপুর ভিএফ নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট গণনা শেষে প্রথমে জয়ী ইউপি সদস্যদের নাম ঘোষণা করা হয়। এতে ৩ নম্বর ওয়াডের্র ইউপি সদস্য পদে বাবুল হোসেন ৪৯৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আজাদ আলী পেয়েছেন ৪৪২ ভোট ও খালেদুর রহমান পেয়েছেন ২৪৫ ভোট।
কিন্তু ওই ফল প্রত্যাখ্যান করে পরাজিত ইউপি সদস্যপ্রার্থী আজাদ আলী ও খালেদুর রহমানের সমর্থকেরা লাঠিসোঁটা নিয়ে ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রিজাইডিং অফিসার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সেখান থেকে বের হতে বাধা দেন। সাথে সাথে পুলিশের সহায়তায় কেন্দ্র থেকে তাদের বের করে উপজেলা নির্বাচন কনট্রোল রুমে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
পরক্ষণে উপস্থিত জনতা আরো উত্তেজিত হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এতে কাজ না হওয়ায় হামলাকারীদের লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি ছোড়ে।
ঘটনার সূত্রপাত জানতে ভোটে জয়ী মেম্বার প্রার্থী বাবুল হোসেনের বলেন, ‘ফলাফল পাওয়ার পর আমিসহ আমার সমর্থকরা উপজেলা পরিষদে চলে আসি। সেখানে এসেই জানতে পারি, নির্বাচনী ফল না মানতে বিশৃঙ্খলা চলছে এবং গুলিতে এক শিশু নিহত হয়েছে।
উপজেলার মীরডাঙ্গী এলাকার বাদশাহ মিয়ার ৯ মাস বয়সী মেয়ে সুরাইয়া মায়ের কোলে থাকা অবস্থায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এ ঘটনায় ভিএফ নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মোঃ খতিবর রহমান ৩০ জুলাই একটি মামলা করেছেন। এতে অজ্ঞাতনামা ৩০০ থেকে ৩৫০ জনকে আসামী করা হয়েছে।
প্রিসাইডিং কর্মকর্তা খতিবর রহমান বলেন, ইউপি সদস্য পদে পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকেরা তাঁদের ওপর হামলা করেছিলেন। তবে তাঁদের পরিচয় জানা যায়নি বলে এজাহারে কারও নাম উলেখ করা হয়নি।
ওই দিন রাতে ভোট গ্রহণের দায়িত্ব শেষে ফেরার সময় মীরডাঙ্গী বাজারের ১৫০ গজ দক্ষিণে পুলিশের ওপর হামলা হয়। এ ঘটনায় ঠাকুরগাঁও সদর থানার এএসআই বিলাশ চন্দ্র রায় একটি মামলা করেন। মামলায় ১৫০ থেকে ২০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী করা হয়েছে।
শিশু সুরাইয়ার মৃত্যুর ঘটনায় ওইদিন তাৎক্ষণিকভাবে লাশ নিয়ে বিক্ষোভ করেন স্থানীয় লোকজন। ওই সময় তাঁরা রাণীশংকৈল আঞ্চলিক মহাসড়ক অবরোধ করেন ও রাণীশংকৈল থানা ঘোরাও করে রাখেন। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
উপজেলার বাচোর ইউনিয়নে পরে রাত সাড়ে দশটার দিকে আঞ্চলিক মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। এ ঘটনায় রাণীশংকৈল থানার এএসআই আহাদুল জামান বাদী হয়ে ৩০ জুলাই একটিমামলা করেন। ওই মামলায় অজ্ঞাতনামা ২০০ থেকে ২৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এদিকে মামলার কথা শুনে অনেকেই গ্রেপ্তার আতঙ্কে এলাকা ছেড়েছেন। হাতে গোনা কয়েকটি দোকান ছাড়া গ্রামের প্রায় সব দোকান বন্ধ রয়েছে। প্রতিবেশী এক নারী জানিয়েছেন, কিছু লোক এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। তবে কোথায় গেছেন, তা তাঁরা জানাননি।
৯ মাস বয়সী শিশু সুরাইয়ার ময়নাতদন্ত শেষে মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান হাবিবুর রহমান জানান, শিশুটির মাথায় আঘাত ছিল। এটি লোহার রডের আঘাতেও হতে পারে, বুলেটের আঘাতও হতে পারে। খুলির একটি অংশ পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রামকৃষ্ণ বর্মণকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গুলিতে নিহত সুরাইয়ার বাবা মো. বাদশাহ মিয়া বলেন, ‘সুরাইয়ার মতো আর কারও সন্তান যেন এভাবে মারা না যায়।
এ ব্যাপারে ওই কেন্দ্রের দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রিজাইডিং অফিসার খতিবর রহমান বলেন, ফলাফল ঘোষনার পর উপজেলা কনট্রোল রুমে আসার পথে পরাজিত মেম্বার প্রার্থীদের সমর্থকরা আমাদের পথ অবরোধ করে। পরে পুলিশের সহায়তায়, নির্বাচনী মালামাল এবং আমিসহ নির্বাচনে জড়িত সংশ্লিষ্ঠ সকলেই গাড়ি নিয়ে চলে আসি। আমরা কনট্রোল রুমে পৌঁছার পর ওই কেন্দ্রে থেকে যাওয়া পুলিশের সাথে উত্তেজিত জনতার ইটপাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ি ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয় এবং পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুলি ছোঁড়ে এ খবর আমি জানতে পারি।
রাণীশংকৈল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম জাহিদ ইকবাল বলেন এ ব্যাপারটা ৩ টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এবং তিনি গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘নিরীহ ও সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হবে না। নির্ভয়ে আপনারা এলাকায় থাকুন। পরের কথায় কান না দেওয়ার অনুরোধ করেন মর্মে তিনি জানান।
জেলা পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এ নিয়ে থানায় ৩ টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এলাকায় আতংকের বিষয়ে এস পি বলেন,কোন নিরপরাধ ব্যক্তি যেন হয়রানির শিকার না হন সেদিকে আমরা লক্ষ্য রাখবো।