তিমির বনিক, মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি: আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মৌলভীবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় চলতি রবি মৌসুমে বাড়ছে সরিষার চাষ। উন্নত জাতের সরিষা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন এ জেলার কৃষকরা। সরিষার ব্যাপক ফলনে গ্রামীণ অর্থনীতিতে দেখা দিচ্ছে সম্ভাবনার হাতছানি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরে সরিষার ফলন ভালো হবে। এবছর সরিষার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩১০ হেক্টর জমিতে। সেখানে চাষ হয়েছে প্রায় ২৪০০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের চেয়ে প্রায় ২০০ হেক্টর জমিতে বেশি চাষ হয়েছে সরিষা। প্রতি হেক্টরে ১.৪ মেট্রিক টন সরিষা উৎপাদন হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় কৃষকদের সূত্রে জানা গেছে, জেলার সিংহভাগ সরিষা উৎপাদন হয় বড়লেখা উপজেলায়। বড়লেখার হাকালুকি হাওরের বিস্তীর্ণ মাঠ এখন হলুদ রঙে সেজেছে। পাশাপাশি ওই এলাকায় আবার সরিষার জমির পাশেই মৌ চাষ বেড়েছে। সরিষা মাঠে কিংবা বাড়ির পাশে বাক্স বসিয়ে মৌ চাষিরা মধুও সংগ্রহ করছেন। ফলে সরিষা চাষি ও মৌ চাষি উভয়েই লাভবান হওয়ায় সরিষা চাষ বেড়েছে।
বড়লেখা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে সরিষা চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রচলিত দেশি সরিষার চেয়ে উচ্চ ফলনশীল জাতের বারি-১৪ ও বারি-১৫ ফলন বেশি হওয়ায় চাষিরা আগ্রহী। চাষিরা প্রতি বিঘা জমি থেকে ৬-৭ মণ সরিষা উৎপাদনের আশা করছেন। আমন ধান সংগ্রহের পর জমি ফেলে না রেখে সরিষা চাষ করেছেন। এরপর আবার বোরো ধান রোপণ করবেন কৃষকরা। এতে একই জমিতে বছরে তিনবার ফসল উৎপাদন হচ্ছে।
একাধিক কৃষক বলেন, বারি-১৪ ও বারি-১৭ সরিষা গাছের উচ্চতা হয় দেড় থেকে ২ ফুটের মতো। আগে সরিষা গাছ বড় হলেও ফলন কম হতো। নতুন জাতের ছোট আকারের এ সরিষা সঠিক পরিচর্চায় গাছের গোড়া থেকে মাথা পর্যন্ত ফল আসছে। বীজ বপনের ৭৫-৮০ দিনের মধ্যেই ক্ষেত থেকে সরিষা সংগ্রহ করা যায়।
বড়লেখা উপজেলার তেড়াকুড়ি গ্রামের আব্দুল খালিক বলেন, সাত-আট বছর ধরে সরিষা চাষ করেন। সরকারি প্রণোদনা পাওয়ায় এবার ১২ বিঘার মতো সরিষা চাষ করেছেন। বাজারে সরিষার দাম ভালো থাকায় প্রতি মণ সরিষা বিক্রি করা যায় ২৫০০ থেকে ৩০০০ হাজার টাকা দরে। সরিষা চাষে সময় ও সেচের প্রয়োজন কম। আবার বীজের কোনো সমস্যা হয় না। সব মিলিয়ে কম খরচে বেশি লাভের জন্য বোরো লাগানোর আগে সরিষা এখন সেরা ফসল।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার আশিদ্রোন ইউনিয়নের ইকবাল মিয়া জানান, সরকারি প্রণোদনা পেয়েছি। তাই এবছর ৮ বিঘা সরিষা চাষ করেছি। মাঘ মাসে সামান্য বৃষ্টি হয়েছে। তাতে সরিষার জন্য ভালো হয়েছে। তবে বেশি বৃষ্টি হলে ক্ষতি হবে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াসমিন মোনালিসা সুইটি জানিয়েছেন, ২০২১ সালে শ্রীমঙ্গলে ৮৫ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছিল। এবছর ১০২ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। সরিষা চাষের জন্য সরকারি প্রণোদনার পাশাপাশি কৃষকদের সরিষা চাষে অনুপ্রাণিত করছি। আমন ও বোরো আবাদের মধ্য সময়ে সরিষা চাষ করা যায় বলেই কৃষকদের মাঝে সরিষা চাষের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। সরিষা চাষের পাশাপাশি মৌ চাষে মৌমাছির কারণে পরাগায়নে প্রায় ২০ শতাংশ ফলন বেশি হয়ে থাকে। তাই সরিষা চাষের সঙ্গে মৌ চাষে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কাজী লুৎফুল বারী বলেন, তেল ফসলের মধ্যে সরিষা অন্যতম। এক সময় অধিকাংশ মানুষ সরিষার তেল দিয়েই বিভিন্ন খাবার রান্না করে খেত। সে সময় মানুষের শরীরে রোগও কম হতো। কালের বিবর্তনে কৃষক পর্যায়ে সরিষার আবাদ হ্রাস পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ধরনের তেল বিদেশ থেকে আমদানি করে বাজার সয়লাভ করে দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থের অপচয় করছেন।
এতে সরিষার দাম কমে যায়। ফলে কৃষকরা সরিষা চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। তাই আমদানি নির্ভরতা কমাতে এবং দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ও কৃষকের লাভজনক কৃষি উৎপাদনের বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন ১৪, ১৫ ও ১৮ উচ্চ ফলনশীল জাতের সরিষা বারি।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. দেবাশীষ সরকার জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে এক ইঞ্চি জায়গাও যেন পতিত না থাকে। তারই নির্দেশে নতুন নতুন জাত আবিষ্কারের মাধ্যমে হাওরাঞ্চলে শস্যের নিবিড়তা বাড়াতে নিরলস কাজ করছি। আমরা জানি যে সিলেট অঞ্চলে এক ফসলি জমি বেশি। এক ফসলি জমিকে কিভাবে দুই বা তিন ফসলি জমিতে পরিণত করা যায় এরই প্রচেষ্টা চলছে।
আমাদের বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত সরিষা ১৮-এ জাতটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ জাতের তেলে ইরোসিক এসিডের পরিমাণ একেবারেই সামান্য, যা শতকরা ০.৫ ভাগ। এ জাতটি জনপ্রিয়তা পেলে অনেকেই আবারো সয়াবিন বা পাম তেলের পরিবর্তে সরিষা তেলকে ভোজ্য তেল হিসেবে গ্রহণ করবেন। এ জন্যই বারি হাওরাঞ্চলে শস্যের নিবিড়তা বাড়াতে চেষ্টা চলছে।