কলমে- মোঃ আবু শামা (শ্যামা)
ভেতরে একটা ব্যাংকের সই করা চেক, সেখানে টাকার অংক এক লাখ সাত হাজার টাকা। আমি চাচাকে বললাম, চাচা আপনি কেন চিঠির খামটা খুলেন নাই? সে যখন হাসপাতালে ছিলো, দেখেন এখানে এক লাখ সাত হাজার টাকার চেক। আপনি যদি সেই সময় চিঠির খামটা খুলতেন তাহলেই আপনি অন্তর কে বাঁচাতে পারতেন চাচা। এই টাকা দিয়েই সব চিকিৎসা হতো চাচা।
চাচা বললো, সব দুর্ভাগ্যরে মা, সব দুর্ভাগ্য সাহেবের। আর বলে কি হবে রে মা, যে চলে গেছে তার কথা আর ভেবে কি লাভ? এখন যে আসতেছে তার কথা ভাবেন গো মা, তার কথা ভাবেন।
আমি কি ভাবে অন্তরের কাছে মাফ চাইবো? ঐ পারে যাবার পর? আমার জন্য জীবন দিয়ে গেলো, আবার আমার জন্য শেষ সম্বলটাও রেখে গেছে, আমার পাপের ক্ষমা নাই। আজ আমি সেই টাকা দিয়ে আমার চিকিৎসা করেছি। আমার সন্তান জন্ম দিয়ে সে সন্তানকে নিয়ে বেচে আছি। তার ডাইরিতে শেষ একটা স্বপ্ন একটা জায়গায় লিখে গিয়েছিলো। যদি তার একটা সন্তান হতো তাহলে তাকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করাতো, আর তার মত অভাবের মধ্যে জীবন যাপন করতে দিতে না।
আমার হাতের ডাইরিটা আমার চোখের জলে ভিজে যাচ্ছিল। তখন আমার ছোট বোনের ডাকে নিজেকে ফিরে পেলাম, বললো- ভাইয়া আপনি এখানে আর আমি আপনাকে খুজে হয়রান হয়ে যাচ্ছি। এই ঔষধ গুলো তাড়াতাড়ি দোকান থেকে নিয়ে আসেন।
হাসপাতালের জরুরি কাজের পর বিকালে একটু সময় পেলাম। তখন নির্জন জায়গায় গিয়ে মিনুর রেখে যাওয়া ডাইরিটা খুললাম। ডাইরিটা খুলতেই চোখ কপালে উঠে গেলো। মার্চ মাসের ২৩ তারিখ যেদিন অন্তর ভাই কে প্রথম মিনুর ছবি দেখিয়েছিলাম।
অন্তর ভাই মিনুকে নিয়ে যা লিখছে, তা কেবল কেবলই একজন পাগল প্রেমিকের পক্ষেই সম্ভব।
অন্তর ভাই মিনুকে নিয়ে তার অনুভুতি কথা পড়তে শুরু করলাম। লিখেছে- মায়া মায়া মায়া মানুষের কপালে এতটা মায়াময় আবহ প্রকাশ পায় তোমার কপালটা না দেখলে আমার আজন্ম অজানাই থাকতো। তোমার নাম তো মিনু, আচ্ছা তোমার কপালে যে এতটা মায়া তুমি কি জানো? জানলে নিজেকে নিজেই হিংসা করতে। আমার কিন্তু হিংসা হচ্ছে না। কারণ তোমার মত মায়াবতী মানুষের যোগ্য আমি নই তাই হিংসা করার প্রশ্নই আসে না। তবে আমি আমার কল্পনায় তোমাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুযোগ করে দিলাম। বেশ তবে তাই হোক এবার তোমার একটা নাম না দিলে কেমন হয়, তাই তো তোমার নাম দিলাম “মায়া”। তোমার নাম মায়া দিলাম কেন খুব জানতে ইচ্ছে করছে তাই না?
ঠিক আছে তোমাকে বুঝিয়ে বলছি, যার কপালে এতটা মায়ায় ভরা তার নাম মায়াই হওয়া উচিত। কারণ তোমার মায়া আর সম্মোহনী যাদুর শক্তিতে আমাকে সম্মোহিত করেছে। আমি আর নিজের মধ্যে নেই, নিজের অজান্তেই তোমার মায়ার প্রেমে পড়ে গেছি। অপেক্ষায় রইলাম তোমার এই পবিত্র মায়াভরা মুখখানি একটি বার চক্ষু মেলিয়া দেখার।
ডাইরির প্রতিটা পাতায় শুধু মিনু মানে মায়াকে নিয়ে লেখা প্রতিদিনের সৃতিচারণ। ডাইরির পুরোটা পড়ছিলাম আর অশ্রু ঝরছিল আমার, তারপর ডাইরির শেষ লেখাটা।
অন্তর ভাইয়ের শেষ কথা ছিলো, যেদিন মিনু তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো-
” মায়া”,
প্রথম যেদিন তোমার মুখটা দেখেছিলাম তোমার হাতটা ধরে বলেছিলাম, বিশ্বাস রাখুন আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে আপনাকে রক্ষা করার চেষ্টা করবো। আর আপনাকে সম্মানের সাথে ভালোবেসে যাব আজীবন।
তুমি শুধু মৃদু হেসেছিলে। সেই হাসিটা কি আজকের এই দিনটার জন্যই, আমাকে তোমার জীবনে প্রয়োজন শেষ তাই আমাকে ছেড়ে চলে যাবে বলে!
খুব জানতে ইচ্ছে করছে তোমাকে কি আমি নিরাপত্তা দেইনি? দেইনি কি অবাধ স্বাধীনতা? তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কখনো একটা কাজ করেছি? তোমার মনে পরে কি একটিবারের জন্যও তোমার মুখে তুলে খাইয়ে না দিয়ে নিজে একলোকমা খাবার খেয়েছি?
হাঁ সেদিন থেকে তোমার মুখে তুলে খাইয়ে দেইনি, যেদিন তুমি আমার সমস্ত আশা আকাংখা বিশ্বাস ভেঙে চুরে তছনছ করে দিয়ে তোমার বন্ধুকে নিজের হাতে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছিলে। আর তা আমার নিজের চোখে দেখতে হয়েছে। ঢাকার বাইরে লং ড্রাইভে আমারি কোম্পানির প্রজেক্টের সামনে তোমার বন্ধুকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছিলে, আর আমি অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখতে বাধ্য হয়েছিলাম। শুধু তোমার সম্মান রক্ষা করার জন্য কাউকে কিছুই বলিনি। কারণ প্রথম দেখায় তোমাকে কথা দিয়েছিলাম তোমার নিরাপত্তা আর সম্মান রক্ষা করবো আজীবন।
তবে সেইদিন বুঝতে পারছিলাম যার মুখে নিজের হাতে খাবার খাইয়ে না দিলে একটাবারও খাবার খেয়ে শান্তি পেতাম না, অথচ তোমার হাতে এক লোকমা খাবার খেতে পাগলের মত মনটা ছটফট করতো তুমি একটিবার বুঝতেও পারোনি। অথচ আজ রাস্তার পাশে বসে বন্ধু মুখে খাবার তুলে খাইয়ে দিচ্ছো।
আর আমি এতটা বছর একবারের জন্য বুঝতে পারিনি আমি এর জন্য নই, শুধু অপেক্ষা করে নিজেকে সান্তনা দিয়েছি। আর না। তুমি বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাবে এতে আমি তো তোমাকে কখনো প্রশ্ন করিনি। যদিও তোমার ব্যপারে অনেকেই আমাকে অনেক আজেবাজে কথা বলতো, কিন্তু তোমার প্রতি আমার অসীম বিশ্বাস ছিলো।
আজ আমার সব বিশ্বাস ভেঙে গেলো। এতকিছুর পরও আরো একটা বছর তোমাকে শুধরিয়ে দেবার চেষ্টা করেছি, কোন কিছু তে অপূর্ণ তো রাখিনি! আমার ভালোবাসায় তো কোন কমতি ছিলো না। অথচ তোমার চোখ আমার জন্য ন্যুনতম ভালোবাসা দেখিনি একটিবারের জন্যও।
শুধু এক সেকেন্ডের জন্য যদি তোমার চোখে আমার জন্য ভালোবাসা প্রকাশ করতে আমার জীবনের আর কোন চাওয়া থাকতো না মায়া। আমার অপেক্ষার অবসান হলো না মায়া, তুমি মায়ার সমস্ত বাঁধন ছেড়ে আজ চলেই গেলে, জীবনের সমস্ত সঞ্চয় আর ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে সুখী করতে পারলাম না।
জানি না সুখী হতে পারবে কিনা অন্য কারো সাথে। আমি হয়তো বুড়ো মানুষ তোমার মনে ভালোবাসা জন্মাতে পারিনি। যে জন্মাতে পেরেছে তাকে নিয়ে সুখী হও। ভালো থাকা হয় যেন শুভকামনা ।।
“সমাপ্ত”