কলমে- মোঃ আবু শামা (শ্যামা)
চিরকুটটা পড়ে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। মিনু, সে আমার মিনু ছিলো এত কাছে থেকেও তাকে একটাবার চিনতে পারলাম না, কতটা অকৃতজ্ঞ আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারলাম না। আমি যেন ভাবলেশহীন হয়ে সেই অতীতে ফিরে গেলাম। এই আমি একদিন মিনু কে অন্যর হাতে তুলে দিয়েছিলাম। মনে পরে গেলো আমার এক বড় ভাই অন্তর ভাইয়ের কথা, যিনি আমাকে আমার জীবনের দূরদিনে আমার পাশে না দাড়ালে আমার যে কি হতো জানতাম না।
আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট পড়ছি, দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া বন্ধ হবার পালা। তখন অন্তর ভাই ঢাকাতে চাকরি করত। আমি কিছু একটা করার আশায় তার কাছে ঢাকায় গেলাম। তিনি আমাকে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন দুই মাসের মধ্যে আমাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দিলেন। তাতে আমার লেখাপড়ার পর কিছু টাকা আমার পরিবারে দিতে পারছিলাম। একদিন তার বাসায় গেলাম, তিনি নিজে রান্না করে খান আমাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ালেন।
তার পর খোশগল্পের মাঝে বলে ফেললাম, অন্তর ভাইয়া আপনি বিয়ে করেন না কেন, একাই রান্না করে খান কষ্ট হয় না? তাছাড়া ভালো চাকরি করেন, এবার একটা বিয়ে করেই ফেলেন।
তিনি মৃদু হেসে বললেন, আমাকে এই বুড়ো বয়সে কে বিয়ে করবে রে পাগলা। অন্তর ভাই বরাবরই মৃদু ভাষি মানুষ, খুব সহজ সরল, এতটুকুও অহংকার নেই। এবং খুব মিশুক মানুষ সবার সাথেই সরল মনে মিশে যায়, তাতে অনেক সময় ঠকেও যান তবুও অনেক মানুষ কে উপকার করে, যেমন আমাকে উপকার করেছে, এখনো করছেন।
আমি মজার ছলে মিনুর ছবিটা অন্তর ভাইকে দেখিয়ে বললাম এই মেয়েটা কেমন লাগে বলুন তো, অন্তর ভাই ছবিটা দেখে বললেন, হাঁ দেখতে তো ভালোই। আমি বললাম বলেন কি শুধু ভালোই বললেন যে, আপনি বুঝেনই না, এত সুন্দরী একটা মেয়ে কে আপনি বলছেন শুধু ভালোই, আপনার রুচিই নাই, এ জন্যই তো বুড়ো হয়ে গেলেন একটা বউ যোগাড় করতে পারলেন না।
হঠাৎ মুখ ফসকে কথা টা বলে নিজেই খুব লজ্জা পেলাম। অন্তর ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি তার মুখ টা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বুঝতে পারলাম খুব কষ্ট পেয়েছে। বুকের মধ্যে চাপা কষ্ট নিয়ে শুধু বললেন, মেয়ে টা সুন্দরী হলেই কি আর না হলেই আমার কি আসে যায়, রে পাগলা।
আমি বললাম কি আসে যায় মানে এই মেয়ের সাথে আপনার বিয়ে দেব, মেয়ে টা আমার খুব কাছের বান্ধবী, খুব ভালো মেয়ে আর খুব ভালো ছাত্রী, তবে খুব দুঃখী মেয়ে তার মা মারা গেছে, সৎ মায়ের সংসারে খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করছে, বাবা খুব গরীব। আপনি বিয়ে করলে মেয়ে টা বেচে যাবে। আপনার সাথে খুব মানাবে, আপনি শুধু পড়াশোনা করাবেন, তাতেই সে খুব ভালো থাকবে।
গরীবের মেয়ে শুনে অন্তর ভাই আমাকে দিকে তাকিয়ে বললেন, বলিস কি আমার মত গরীব ঘরের মানুষ?
আমি বললাম, বলেন কি আপনি গরীব হবেন কেন, আপনার মত এত বড় মনের মানুষ আর এ জগতে একটাও আছে নাকি। অন্তর ভাই তখন আমাকে তার জীবনের কষ্টের কথা গুলো বলেছিলেন, কত কষ্ট করে লেখাপড়া করেছেন। তিনিও গরীব ঘরের সন্তান। তার কষ্টের কথা শুনে আমার চোখে পানি চলে এলো,তারপর আমি আমার মোবাইলে মিনুর ছবিটা দেখতে দিয়ে বললাম ছিবিটা ভালো করে দেখেন, আমি ওয়াশরুম থেকে আসি। আমি ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এসে দেখি অন্তর ভাই মিনুর ছবিটার ঠিক কপালটায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, আর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মিনুর ঠিক কপালটার দিকে, আমি অবাক হয়ে দূশ্যটা দেখছিলাম।
হঠাৎ আমার মনে হলো হায় রে ” আজ বুঝি নিজের হাতে নিজের পায়ে কুঠার টা মারলাম ।”
আমি অন্তর ভাইয়ের পাশে এসে বসলাম, তখনও অন্তর ভাই মিনুর ছবির কপালটার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমি বললাম, অন্তর ভাই এখন বলেন আমার বান্ধবী কেমন সুন্দরী। অন্তর ভাই শুধু মৃদু হেসে বললেন, মেয়েটার কপালে খুব মায়া রে, আর এই মায়া তাকে নিয়ে গেলো অনেক দূর।
আমি বললাম, এখন বলেন আমার বান্ধবী কে কি বিয়ে করবেন? আবারো মৃদু হেসে বললেন, তাই কি হয়, এমন সুন্দরী মেয়ে আমার মত টাক পড়া কুৎসিত মানুষকে বিয়ে করতে রাজি হবে। আমি বললাম এসব আমার উপর ছেড়ে দেন, যা করার সব আমি করবো। আপনি শুধু হাঁ বলেন। অন্তর ভাই বললেন, ঠিক আছে কথা বলে দেখ, আবার সেই বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে কথা বললেন, আমার বুঝতে এতটুকুও অসুবিধে হলো না।
আমি চঠ করে বলে উঠলাম, ঠিক আছে আগামী ২৬ শে মার্চের ছুটির সময় আপনি আমার সাথে আমার বান্ধবী কে দেখতে যাবেন, আমি সব ঠিক করছি। অন্তর ভাই বললেন ঠিক আছে, দেখি তুই কি করতে পারিস।
যে কথা সেই কাজ, ঠিক ২৬ শে মার্চ তারিখে আমি অন্তর ভাই কে নিয়ে মিনুদের বাড়িতে গিয়ে হাজির, যদিও সবকিছু মিনুর পরিবার কে জানানো হয়েছিলো, তো আমরা মিনুদের বাড়িতে যাবার পর তাদের সামর্থ্যের যথাযথ আপ্যায়ন করা হলো।
সেখানে কিছু মুরুব্বি ছিলেন অন্তর ভাই কে জিগ্যেস করলেন তোমার কি মেয়ে পছন্দ হয়েছে? অন্তর ভাই অকপটে বলে দিলেন, ” পছন্দ করেই তো এসেছি।”
সবাই উত্তর শুনে অবাক, অন্তর ভাই বলেন দেখুন ছবিতে দেখেছিলাম, তখন ই বড্ড মায়া লেগেছিল, সুতরাং অপছন্দ হবার কোন কারণ নাই। পছন্দ হয়েছে বলেই ঢাকা থেকে ছুটে এসেছি।তারপর অনেক কথা পর অন্তর ভাই বললেন দেখুন আমার বাবা নেই আপনারা চাইলে আমার গরীব ঘরে আপনারা আসতে পারেন।
তারপর আমি সহ মিনু বাবা আর চাচা অন্তর ভাই দের বাড়িতে গেলাম। সেসময় যৌতুকের টাকা নিয়ে কথা উঠলো, অন্তর ভাই স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন একপয়সাও যৌতুকের দাবি নেই। আপনারা সবাই আমার জন্য দোয়া করে দিবেন। সেই দিন ই দুই পরিবার থেকে ঠিক করলো, আগামীকালই বিয়ে, কারণ যেহেতু ছেলে ঢাকায় কোম্পানির চাকরি করে, তাই সময় পায়না তাই কালই বিয়ে, ২৭ শে মার্চ বিয়ে হয়ে গেলো।
মিনুর বিয়ের পর আমি ইচ্ছে করেই তাদের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিলাম। তাছাড়া আমার চাকরি পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। মাঝে মধ্যে খবর পেতাম তারা বেশ ভালো ভাবেই আছে, সুখে শান্তিতে বসবাস করছে। কিন্তু অনেক গুলো প্রশ্ন আমাকে পিড়া দিতে লাগলো, মিনু কেন গভীর রাতে রাস্তায়, কি করছিলো, একটা নারী কন্ঠে তাকে সখি ডেকে কেন আজেবাজে কথা বলছিলো, তবে কি মিনু গভীর রাতে রাস্তায় থাকে, ছি ছি, কি ভাবছি,নাহ এ হতেই পারে না। নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারছিলাম না, মিনু কে এত কাছে পেয়েও চিনতে পারলাম, অথচ আমার এই বিপদে নিরবে এত বড় উপকার করে গেলো। আর আমি মিনু কেন গভীর রাতে রাস্তায় কি ছিল, জানতে পারলাম না, মিনুরও কি কোন বিপদ ছিলো, আর ভাবতে পারছিনা না, হতাশায় দেয়ালে মাথা ঠুকতে লাগলাম।
হঠাৎ আমার ছোটবোন এসে বলছে ভাইয়া আপনি এ কি করছেন, পাগল হলেন নাকি? তাড়াতাড়ি আসুন আপুর জ্ঞান ফিরেছে, আপনাকে দেখতে চাইছে।
আমি আমার স্ত্রী কাছে গেলাম, মা মেয়ে সুস্থ আছে দেখে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। তারপর সারাদিন হাসপাতালে ব্যস্ত ছিলাম। তারপর রাত নেমে এলো, তখন মিনুর কথা খুব মনে পড়ে গেলো, তখন ঠিক করলাম, মিনু কে খুজে বের করা দরকার। কিন্তু কোথায় তাকে খুঁজবো, অবশেষে ভাবলাম গতরাতে যেখানে তাকে পেয়েছিলাম সেখানে খুঁজবো, কোন না কোন ভাবে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে।
রাত ১২ টার পর শান্তিনগর ফ্লাইওভারের আশেপাশে তাকে খুঁজতে লাগলাম, কোথাও তার দেখা নাই, প্রচন্ড হতাশা আমাকে ঘিরে ধরলো। রাত প্রায় দেড়টা, ভাবলাম এভাবে কি আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়, বরং হাসপাতালে ফিরে যাই। হঠাৎ একটা নারী কন্ঠে ভেসে এলো, মামা লাগবে নাকি, যা দিবেন খুশি মনে তাই চলবে।
আমি ভাবলাম মিনু নয়তো? তার কাছে ছুটে গেলাম। নারী কন্ঠেস্বর আমাকে বলে উঠলো কি মামা লাগবে। আমি বললাম, না ঠিক সেটা নয়, গতকাল রাতে একটা মেয়ে ছিলো এখানে নাম মিনু সে কি আজ এসেছে?
মেয়েটি বলবো মিনু টা আবার কে? আমি বললাম, গতকাল রাতে আমাকে রিক্সা করে এখন থেকে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো। মেয়ে টি বললো, আপনি সেই নাগর, কাল কি খুব আনন্দ দিয়েছে আমার সখি যে, আজও এসেছেন?
আমি বললাম আমাকে ক্ষমা করুন, আর দয়া করে অন্য কিছু ভাববেন না, আমার খুব বিপদ ছিলো, আপনি কি তার কোন খোঁজ দিতে পারবেন?
মেয়ে টি আমার কথায় সদয় হলো। কি বিপদ বলুন তো। আমি বললাম, আমরা একটু বসে কথা বলতে পারি, আমি খুব ক্লান্ত। মেয়েটি পাশে একটি টং দোকানে নিয়ে গেলো, আমরা বসে পরলাম। আমার দিকে চা কাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন,এবার বলুন আপনার বিপদ টা কি? আমি মেয়ে টিকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। মেয়েটি আমার সব কথা বিশ্বাস করলো, সখি কে আমার আগে থেকেই সন্দেহ হয়েছিল, আমি বললাম, মিনু কে কোথায় পাবো? তার ঠিকানা আমাকে দয়া করে দিবেন, সবই তো শুনলেন, তাকে আমার কতো দরকার।
মেয়ে টি বললো, আমি সখির ঠিকানা জানি না, কতবার যে তাকে জিজ্ঞেস করেছি বলেনি, তবে তাকে একদিন একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সামনে দেখেছিলাম, তার বাচ্চার সাথে ছিলো, সেই স্কুলে তার বাচ্চা পড়ে, আমাকে হাত জোর করে বলেছিলো বোন, কাউকে বলিও না। আমি খারাপ মানুষ, তাই আমি কাউকে কিছু বলিনি ৷ কারণ আমারও সন্তান আছে, আমরা পেটের দায়ে পাপের পথে পা বাড়িয়েছি, আমিও চাই না আমার সন্তানও কারো কাছে ছোট হোক।
আমি বললাম, তার ফোন নম্বর টা আমাকে দিন। সে বললো, সখি আমাকে তার ফোন নম্বর টাও দেয়নি, সত্যি বলতে এই লাইনে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। তাছাড়া সখি এই লাইনে বেশি দিন হলো আসেনি। আমি বললাম তার নাম কি সখি বললে কেউ চিনবে, মেয়ে টি বললো, না চিনবে না, আসলে এই লাইনে আমরা একে অপর কে সখি বলেই ডাকি, সবাই সবার সখি, বলেই অট্টহাসিতে হাসতে লাগলো।
আমি মেয়ে টি কে বললাম, আমি তাহলে তাকে কোথায় খুজে পাব? মেয়েটি বললো, চিন্তা করবেন না, আপনার ফোন নম্বর দিয়ে যান, তাকে পেলেই আপনাকে ফোন করে জানাবো।
আমি বললাম কাল একবার এখানে আমি আসবো আপনি থাকবেন। মেয়ে টি বললো খবরদার এখানে আপনি কখনোই আসবেন না। আপনি ভালো মানুষ বিপদে পড়ে এসময় এখানে এসেছিলেন, আর আসবেন না, আপনার উচিৎ আপনার স্ত্রী সন্তানের পাশে থাকা। আমি কথা দিচ্ছি,সখির কে পেলেই আপনাকে জানাবো,আপনি তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যান।
তারপর আমি রাজ্যের হতাশা নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছাতেই ভোর হয়ে গেলো।
চলবে……………………………………………………