কলমে- মোঃ আবু শামা (শ্যামা)
গভীর রাত প্রায় রাত দুইটা বাজে আমি শান্তিনগর ফ্লাইওভারের নিচে দিয়ে হেঁটে চলেছি, পা দুটা যেন আর চলছে না জগতের সকল বোঝা যেন আমার দুপায়ে ঝুলে আছে, শরীর টা যেন নুয়ে পড়তে চাইছে মাটিতে, মনের গভীরে চলছে জগতের সকল হতাশা, কি করবো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না, কোথায় যাব কি করবো, মাঝে মধ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহ কে ডেকে বলছি আল্লাহ আমাকে কোন পরিক্ষার মধ্যে ফেললে, আজ কি আমার সব শেষ হয়ে যাবে,আমার জন্য কি তুমি এমনই দুর্ভাগ্য লিখে রেখেছিলে,আল্লাহ আমাকে তুমি এই বিপদ থেকে রক্ষা করো, তুমি ছাড়া আমার এই বিপদ থেকে রক্ষা করার আর কেউ নাই। এক পা দু পা করে এগিয়ে চলার চেষ্টা করছি কিন্তু কোথায় যাব, কিভাবে উদ্ধার পাব আজ আমার সত্যি জানা নাই।
হঠাৎ পিছন থেকে একটা মেয়ে কন্ঠে ভেসে আসছে, মামা লাগবে নাকি, ঐ মামা শুনছেন না, লাগবে নাকি যা দিবেন তাই চলবে, বেশ ক’বার কথা গুলো আমার কানে আসছিলো, আমার তাতে বিন্দু মাত্র আগ্রহ নাই, কে ডাকছে কেন ডাকছে জানি না।
হঠাৎ আমার ফোন টা বেজে উঠল, আমি ফোন টা রিসিভ করতেই ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসলো, ভাইয়া আপনি কোথায় তাড়াতাড়ি রক্ত নিয়ে হাসপাতালে আসুন, আপুর অবস্থা খুব খারাপ, কান্নার শব্দে আমার গলাটা ধরে এলো আমি কিছু বলার আগেই ফোন টা কেটে গেলো, আমি বলতেই পারলাম না, শান্তিনগর কোয়ান্টাম ব্লাড ব্যাংকেও নেগেটিভ রক্ত নেই।
আজ সারাদিন ঢাকা শহরের এই পান্ত থেকে ঐ পান্ত পাগলের মত ছুটে বেড়িয়েছি কোথাও রক্ত সংগ্রহ করতে পারিনি বিভিন্ন রক্তদান সংগঠন ছুটে বেড়িয়েছি কোথাও পাইনি, সারাদিন কতজন বন্ধু কে যে রক্তের জন্য ফোন করেছি কারো কাছেই রক্ত পাইনি, কেউ কেউ রক্ত দিতে চাইছে কিন্তু রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ মেলেনি, এখন ফোন টাও বন্ধ হয়ে গেলে,হাসপাতালে থেকে ছোটবোন ফোন দিয়ে বললো ভাইয়া আপুর অবস্থা খুব খারাপ বলতেই ফোন কেটে গেলে, ফোন বন্ধ হয়ে গেলে, তাহলে কি সব শেষ হয়ে গেলো,আমার দমবন্ধ হয়ে আসছি আমি চিৎকার করে আল্লাহ বলে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লাম।
হঠাৎ নিজেকে ফিরে পেলাম কেউ একজন আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে উঠলো, হতাশ হবেন না, আল্লাহ কে যখন ডেকেছেন তখন তিনি আপনার মঙ্গল করবেই, আমি তার দিকে ফিরেও তাকালাম না, আল্লাহ কে আর ডেকে কি লাভ, আমার তো সব শেষ হয়ে গেলো, আল্লাহই তো আমার সব কেড়ে নিলেন। বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম, পিছন থেকে মেয়ে টি বললো কি বিপদ আপনার, আমাকে বলুন যদি কোন সাহায্যে আসি। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, কে আপনি, আর আপনিই বা আমার আর কি সাহায্য করবেন, আমার তো সব শেষ হয়ে গেছে।
তবুও মেয়ে টি বললো বলুন, আমি রাস্তার মেয়ে তবুও তো মানুষ যদি আপনার একটু সাহায্য করতে পারি। আমি আবারো চিৎকার করে বললাম দূর হয়ে যান, মেয়ে টি আমার হাত চেপে ধরে বললো দয়া করুন আমার জন্য, আমাকে একটা সুযোগ দিন, আবারো বেশি রেগে গিয়ে বললাম, পারবেন উপকার করতে, পারবেন আমার স্ত্রী সন্তান কে ফিরিয়ে দিতে পারবেন।
মেয়েটি আবারো বললো, তা জানি না, তবে আমার মনে হয় আপনি এই বিপদে আল্লাহ কে ডেকেছেন, আপনি যা ভাবছেন ততটা নাও হতে পারে, দয়া করে খুলে বলুন আপনার বিপদটা আসলে কি। প্লিজ।
এবার আমি বললাম, আমি স্ত্রী বারডেম হাসপাতালে সন্তান প্রসব বেদনা ছটফট করছে চার ব্যাগ ও নেগেটিভ রক্ত দরকার দুই ব্যাগ রক্ত দিয়েছি আরো দুই ব্যাগ রক্ত যদি রাত দুইটার মধ্যে না দেয়া যায় তবে মা সন্তান দুই জনই মারা যাবে, এতক্ষণ মনে হয় দু’জন ই মারা গেছে, একটু আগে হাসপাতাল থেকে ছোটবোন ফোন করেছিল, শুধু বললো আমার স্ত্রী অবস্থা খুব খারাপ, তারপর আর শুনতে পারিনি, ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু কান্নার আওয়াজ শোনা গেছে, মনে হয় দুজনেই মারা গেছে।
মেয়েটি আমার কথা শুনার সাথে সাথে আমাকে ঝাপটে ধরে বললো, এখানে আর সময় নষ্ট করার মানে হয় না, উঠুন তাড়াতাড়ি, আমি হতভম্ব হয়ে বললাম কোথায় যাব, মেয়েটি বললো হাসপাতালে, আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোথায় থেকে যেন একটা রিক্সা জোগাড় করে আমাকে টেনে হিঁচড়ে রিক্সায় উঠালো, রিক্সা ওয়ালা কে বললো তাড়াতাড়ি বারডেম হাসপাতালে চলেন মামা।
আমাদের রিক্সা কিছু দূর আসার পর একটা মেয়ে কন্ঠে শুনা গেলো, সখি তুই নাগর পেয়েছিস, যা যা আমার কপালে এখনো জুটেনি। তোর ভাগ্য সবসময়ই ভালো রে, সবসময়ই আমার আগেই নাগর পেয়ে যাস, দিনকাল যা চলছে, আমাদের পেট যে কিভাবে চলবে ভগবান আমাকে চোখে দেখে নাহ, আমাদের মরণ নাই রে। মেয়ে টি উচ্চস্বরে কথাগুলো বলছিলো,একসময় সেই কন্ঠ আর শুনতে পেলাম নাহ।
আমাদের রিক্সাটা খুব দ্রত গতিতে চলছিলো। আমার পাশে বসা মেয়ে টি সেই মেয়ে কন্ঠে শুনা কথাটা কোন উত্তর দেয়নি, যেন একটা পাথরের মূর্তির মত ঠাঁই বসে আছে। আমি কিছু বুঝতে পারছি না, মেয়েটি কে, কেন আমাকে নিয়ে এতো তাড়াতাড়ি হাসপাতালের দিকে ছুটে চলছে, আমার অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু আমার মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না।কিছু জানার মত আমার শরীর মনে কোন শক্তি নাই। হঠাৎ নিজেকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে আবিষ্কার করলাম।
তারপর মেয়ে টি আমাকে রিক্সা থেকে নামিয়ে দিয়ে বললো, আপনার স্ত্রী হাসপাতালের কত নম্বর বেডে আছে চলুন, আমি শুধু বললাম আমার সাথে আসুন, বলেই পাগলের মত ছুটেতে লাগলাম। তারপর হাসপাতালের ভিতরে ঢুকতেই আমার ছোটবোন কে দেখতে পেলাম। সে দৌড়ে এসে বললো ভাইয়া আপনি এতক্ষণে এসেছেন, আমি তাকে জড়িয়ে ধরেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
তারপর কি হয়েছে জানি না। সকাল বেলা আমার জ্ঞান ফিরে পেলাম। আমার সামনে আমার ছোটবোন কোলে করে একটা ফুটফুটে একটা অপ্সরী বাচ্চা নিয়ে এসে আমার কোলে তুলে দিয়ে বললো ভাইয়া এইটা আপনার সন্তান। আমি হতবিহ্বল হয়ে অপ্সরীটা কে কোলে তুলে নিয়ে আল্লাহ কুদরতি পায়ে সিজদাহ্ লুটিয়ে পরলাম। আর আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করতে লাগলাম।
ছোট বোন কে কিছু জিজ্ঞেস করতেই আমাকে বলে উঠলো তাকে বেশি বেশি ধন্যবাদ দিন। আমি বললাম কাকে ধন্যবাদ দিবো?
ছোটবোন বললো, কেন যাকে গতরাতে সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম। পৌঁছানের পরই তো আপনি জ্ঞান হাড়িয়ে ফেললেন। হাঁ তারপর কি হয়েছিলো? আমাকে খুলে বল।
তখন ছোটবোন আমাকে বললো, তাহলে শুনুন আপনি যখন তাকে নিয়ে আসলেন তারপর তো আপনি জ্ঞান হাড়িয়ে ফেললেন। আপনার মাথায় পানি ঢালা হলো ডাঃ একটা ঔষধ খাইয়ে দিলেন তারপর আপনি ঘুমিয়ে পড়ছিলেন। ততক্ষণে ফেরেস্তার মত মহিলাটি ডাঃ কে বললো ডাঃ আমার রক্ত ও নেগেটিভ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার রক্ত নিয়ে রোগীকে বাঁচান।তারপর মহিলাটির শরীর থেকে দুই ব্যাগ রক্ত নিয়ে আপুর শরীরে দেয়া হয়। এবং ভোররাতে আপুকে অপারেশন করে আপনার সন্তানের জন্ম হয়, আপু আর সন্তান দুজনেই সুস্থ আছেন, আলহামদুলিল্লাহ। আর সেই ফেরেস্তার মত মহিলাটি আপনার জন্য একটা চিরকুট রেখে কিছু না বলেই চলে গেছে। এই নিন আপনার চিরকুট।
আমি চিরকুট টা তাড়াতাড়ি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। তাতে লেখা-
“আজ তোমার ভালোবাসার কিছু টা ঋন শোধ করতে পারলাম, পারলে আমাকে ক্ষমা করো, তুমিও ঘর বেঁধেছো দেখে গেলাম, আজ আমার পাপের রক্ত থেকে কিছুটা রক্ত তোমার সন্তানের জন্য দিতে পেরে কিছুটা পাপ মুক্ত হলাম।”
ইতি তোমার “মিনু” ।
চলবে………………………………………