[উৎসর্গ- আমার অত্যান্ত আদর আর স্নেহের রোজ এর জন্য ছোট্ট উপহার ]
ছোট গল্পঃ গপ্পে- শ্যামা!
গ্রামের মেঠোপথে হাঁটছি আনমনে উদ্দেশ্য পোড়াবাড়ি, আমি বরাবরই কৌতুহলী আর প্রকৃতি প্রিয় মানুষ। অনেক দিন পর গ্রামে ফিরেছি, কৌতুহলের জন্য দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি আর ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে বেড়াই। আজ যাচ্ছি চলনবিলের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটা পোড়াবাড়িতে, সেই পোড়াবাড়ি সচারাচর কেউ যাও না, একটা ভূতুড়ে পরিবেশ টের পেলাম যখন আচমকাই একটা গরম বাতাস আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।
আমি যখন পোড়াবাড়ি খুব কাছাকাছি হঠাৎ আমার পা আঁটকে গেলো কেউ একজন আমার পা যেন কাঁমরে ধরেছে প্রচন্দ্র বিষব্যথা অনুভব করলাম, নিচের দিকে তাকাতে পারছি না। আমার শরীর টা যেন ভারি হয়ে আসছে, অনেক চেষ্টা করছি পা টা ছুটিয়ে নিতে কিছুতেই পারছি না। সময় টা ঠিক পড়ন্ত বিকেল, আশেপাশে সাহায্য চাওয়ার কেউ নাই। আল্লাহর নাম নিয়ে বুকে একটা ফুঁ দিয়ে দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করছি।
অবশেষে একটা শীতল বাতাস আমাকে ছুঁয়ে দিলো, একটা হ্যাঁচকা টানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতেই উপর হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে পড়ে গেলাম। তারপর নিজেকে আবিষ্কার করলাম, আমার পায়ে অচেনা লতায় আঁটকে গেছে। তবে মুল সমস্যা টা ছিলো লতার সাথে অনেক ধারালো ছুরির মত কাঁটাতারের আবরণ, তাই পা আঁটকে অনেক জায়গায় কেটে রক্ত ঝড়ছে। বিষের ব্যথা সইতে আর পারছি না, সারা শরীর ঘ্রামে ভিজে গেছি। যেন নদীতে সাঁতার কেটে গোসল দিয়ে আসলাম। নিজের এই আহাম্মক নির্বুদ্ধিতায় ভয় পাওয়াটাকে অনেকটা বেকুবি মনে হওয়ায় হাসতে লাগলাম কিন্তু কাঁটার আঘাত টা খুব যন্ত্রণার, কিছুটা হতাশ হয়ে বসে পড়লাম।
হঠাৎ আমার চোখের সামনে আবিষ্কার করলাম একটা অদ্ভুত সুন্দর বিচিত্র রঙের ফুল, একটা মিষ্টি ঘ্রাণ আমাকে মুগ্ধ করে দিলো। নিজের অজান্তেই ফুল টা স্পর্শ করার জন্য হাত বাড়ালাম। ফুল টা স্পর্শ করতেই একটা আকাশী নীল রঙের মোহনায় নিমজ্জিত হলাম। এক নীল পরীর আবির্ভাব হলো। আমি চোখ দুটা ঘষতে লাগলাম, আমার সাথে কি ঘটে যাচ্ছে এটা? আবার আমার সারা শরীর ঘামতে শুরু করেছে। দেখলাম পরীটার শরীর অপরুপ সৌন্দর্য বিজলির চমক দিচ্ছে, নগ্ন পায়ে আলতা মেখে কোমল ঘ্রাসকে আলিঙ্গন করছে। কোমরে রুপার বৃছা, আগলা গাঁয়ে শাড়ি মোড়ানো, লাল লেজ ফিতার মেঘকালো চুলে বেনী বাঁধা, হাতে মেহেদীর আলপনা এঁকে ইশারা করছে, হরিণীর মত সুন্দর মায়াবী চোখ। চোখে যেন গোলাপের পাপড়ি, সে কি মায়া! সাদাসিধা ঠোঁট বিড়বিড় করে কি যেন বলছে ইশারায়, কপালে ছোট্ট করে টিপ, সব মিলিয়ে তার সৌন্দর্য ঠিক যেন অপ্সরীকেও হার মানায়।
আমার মুখের ভাষা যেন হাড়িয়ে গেছে। চারদিকে নিস্তব্ধতা আর হিমশীতল আবহাওয়া আমাকে কি এক সম্মোহনী শক্তির ধৃষ্টতা দেখিয়ে আমাকে সম্মোহিত করে রেখেছে, সে এক মায়াবী আলোর যাদুকরি মায়াবী শক্তি। যেন কতকাল কেটে গেছে এভাবে সৃষ্টিকর্তা ছাড়া তার হিসাবে কেউ জানে না।
হঠাৎ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কে তুমি? কি চাও? দেখলাম তার মুখটা কালো আধারে ডেকে গেলো, আমি কোন সাড়া না পেয়ে দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ পিছন থেকে আবার কেউ আমাকে আঁটকে দিলো, আমার হাতটা শক্ত করে ধরে ফেলেছে, এবার আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, কে তুমি? কি চাও? আমাকে যেতে দাও!
এবার তার মলিন মুখে একটা শব্দ বের হলো “রোজ”। তারপর ফ্যালফ্যাল করে করুণাভরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কে রোজ? কোন রোজ? আমি কোন রোজ কে চিনি না, আমাকে যেতে দাও, বলেই হাঁকচা টানে নিজেকে ছুটিয়ে নিলাম। তখন মেয়েটির কপোল বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো। মায়াবী কন্ঠে শুধু বললো, তোমার কিশোরী পল্লীবালা, আজও তাকে ফেলে যাচ্ছো টেলিসামাদ!
হঠাৎ আমার বুকটা কেঁপে উঠলো, আমি থমকে গেলাম, শুধু অপলক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছি, আর নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বের হচ্ছে, কিশোরী, পল্লীবালা, আমার রোজ।
মেয়েটি আলতো করে আঙুল দিয়ে আমার ওষ্ঠে স্পর্শ করে বললো, একটু শান্ত হও, তোমার পায়ে অনেক রক্ত ঝরছে, আমাকে একটু সেবা করতে দাও। তারপর সেই অদ্ভুত বিচিত্র সুন্দর ফুল টা ছিঁড়ে, রস বের করে আমার পায়ে মালিশ করতে লাগলো, নিমিষেই আমার পায়ের বিষাক্ত কাঁটার ব্যথা দুর হয়ে গেলো। আরও একটা ফুল তুলে রস চিপে আমাকে খাইয়ে দিলো, যেন এক অমৃত সুধা পান করলাম।
তারপর আমাকে শান্ত শিশুর মত তার কোলে শুইয়ে দিয়ে বললো, এবার দেখতো তোমার রোজ কে চিনতে পারো কিনা। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, সখা আমি তোমার সখি গো, তোমার অত্যন্ত আদরের কিশোরী। যাকে মধুর সুরে পল্লীবালা ডেকে বুকে জরিয়ে নিতে পরম যত্নে, আর বলতে আমার বুকে তোমার নিরাপদ আশ্রয় ময়নাপাখি, আমার মনের মনিকোঠায় শুধু তুমি আত্মা, আমার চোখের নীলাকাশে নিশ্চিন্তমনে ডানা মেলে উড়ে বেড়াবে আর গেয়ে উঠবে, এমন করেই জন্মজন্মান্তরে তোমার বুকে আগলে রেখো আমায় সখা!
হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম মাঠের ঠিক মাঝখানে, আমি লাঙ্গল-জোয়াল গরুর কাঁধে তুলে জমিতে হালচাষ করছি মনের সুখে। আমার ক্ষেতে সোনার ফসল ফলাবো, সংসারের দায়িত্বগুলো বুঝে নেব আমার দুঃখী মায়ের মুখে হাসি ফোঁটাবো, কত স্বপ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
দুপুর গড়িয়েছে অনেক আগে কিন্তু আমার হালচাষ শেষ হয়নি, মনে জিদ চেপে আছে শেষ না করে মায়ের ঘরে ফিরছি না।
হঠাৎ একটা আওয়াজ ভেসে আসছে। এই টেরিসামাদ এই টেলিসামাদ, হাল ছাড়ো হাল ছাড়ো। কাছে আসতেই তার কান চেপে ধরলাম, এই পাগলী তুই আমাকে এভাবে ডাকছিস কেন, কেউ দেখলে আমার মান সন্মান কিছু থাকবে?
কানটা আরও জোরে চেপে ধরে বললাম, আর এভাবে ডাকিবি হ্যাঁ, আমি তোর বড় না ছোট যে, এভাবে ডাকিস। পাগলী জোরে জোরে বলছে, কেউ তো দেখেনি টেলিসামাদ, আমি তোমার জন্য কত কষ্ট করে এই চৈত্রের খড়া রৌদ্রের মধ্যে ভাত নিয়ে আসছি আর তুমি আমাকে মারছো টেলিসামাদ। তুমি এত নিষ্ঠুর মানুষ আগে বুঝিনি।
আমি বললাম, তোকে কষ্ট করে কে ভাত নিয়ে আসছে বলছে, আমি কি বলছি হ্যাঁ?
পাগলীটা মন ভার করে বলছে, ওগো এবার ছাড়ো খুব ব্যথা পাচ্ছি। আমি বললাম, রোজ দিলি তো আমার দুর্বল জায়গায় হাত ডুকাইয়া। রোজ বলছে, আমি জানি আমার পাগলটাকে কিভাবে শান্ত করতে হয়!
আমার কল্পনায় সব সময়ই একটা শব্দ ছিলো, “ওগো”। একবার ভুল করে খাতায় লিখে রেখেছিলাম, ওগো শব্দ টা আমার অনেক ভালো লাগে, তাই আমি যতই রেগে যাইনা কেন, আমার লক্ষী বউ যদি ওগো বলে ডাকে আমার সব রাগ মাটি হয়ে শান্ত হয়ে যাব, এটা আমার প্রতিজ্ঞা।
অনেক মারামারি করছো এবার হাতমুখ ধুয়ে বসে পরো আমি ভাত দিচ্ছি, আমি পানির জগটা নিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম, আর রোজ গামছাটা নিয়ে পরম মমতায় আমার হাত মুখ মুছে দিচ্ছে। আর বলছে আচ্ছা তুমি কি মনে করে আজ ইস্কুলে না গিয়ে সোজা লাঙ্গল-জোয়াল নিয়ে ক্ষেতে চলে আসলে। বললাম শুন রোজ বাবা চলে যাওয়ার পর মা অনেক কষ্টে আমাকে মানুষ করেছে জানিস তো, এবার আমি মার সংসারে দায়িত্ব নিতে চাই, তাই সিধান্ত নিছি, মাঠে যে কয়দিন হালচাষ করা লাগে করবো, বাকিদিন গুলো ইস্কুলে যাবো।
রোজ বলছে ইস্কুলে ঠিক মত না গেলে ফেল করবে, আর ফেল করলে কিন্তু আমাকে বিয়ে করতে পারবা না, বাবা কোন দিন মেনে নিবে না, আমি শুধু বললাম আমি কোন ক্লাসে ফাস্ট না হয়ে কোন দিন সেকেন্ড হয়েছি বল পাগলী, আমার তো একদিন পড়লে দশদিন না পড়লেও হয়, তার চেয়ে বল আমি গরীব আর ইয়াতিম তাই চাচা আমার সাথে তোকে বিয়ে দেবে না, সত্যি তো এটাই।
আমি এ নিয়ে ভাবি না রে পাগলী, আল্লাহ যদি তোকে আমার ভাগ্যে লিখে রাখে তো তুই আমার বউ হবি। না থাকলে না হবি। বলতে বলতেই রোজ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। আমি রোজের চোখের পানি মুছে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, আত্মা রে আত্মা তোমাকে কষ্ট দেবার জন্য বলিনি, আমি শুধু বাস্তবতা জানাতে চাইছি, আর তাই পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারের হাল ধরলাম আজ থেকে। সংসারের উন্নতি করবো তারপর মেট্রিক পাশ করলেই চাকরি, তখন চাচার কাছে তোকে চাওয়ার আগেই চাচা আমার মার কাছে তোকে আমানত হিসেবে তুলে দেবে আমার বউ করার জন্য। আর সব পরিকল্পনা আমার এই লক্ষী কিশোরী পল্লীবালার জন্য, তুই যে আমার আত্মা রে, আমার নয়নের মণি, আমার হৃদয়ে স্পন্দন রে পাগলী।
রোজ বলছে আমার টেলিসামাদ এত সুন্দর পরিকল্পনা করে রাখছে আমি তো ভাবছি, লাঙ্গল-জোয়াল নিয়ে চাষা হয়ে গেলো, আল্লাহ রে আমার কি হবে! এরপর আমার কিশোরী পল্লীবালার মুখে প্রশান্তির ছোঁয়া দেখতে পেলাম।
রোজ বলছে এবার কথা থামাও সখা, একটু শান্তিমত ভাত খাও, রোদের মধ্যে কপাল বেয়ে ঘ্রাম ঝড়ে যাচ্ছে তখন আমার পল্লীবালা তার শাড়ির আচল দিয়ে আমার কপালের ঘ্রাম মুছে দিচ্ছে পরম মমতায়। তখন চৈত্রের খড়া রৌদ্রের তাপদাহ নিমিষেই হারিয়ে গেলো, বিরাজ করলো অসীম সৌন্দর্যের এক জান্নাতি পরিবেশ। প্রশান্তির ছোঁয়ায় মনটা ভরে উঠলো, মুখ থেকে বেড় হয়ে গেলো, জান্নাতি পাপিয়া!
রোজ গোমড়ামুখে বললো, এই জান্নাতি পাপিয়া আবার কে টেলিসামাদ? আমি বললাম তোমার সতীন। রোজ রেগে আগুন হয়ে বললো, টেলিসামাদ থাক তুই, আমি চললাম। আমি পাগলিটার হাত চেপে ধরে বললাম, বলছি একটু শান্ত হও ময়না, রাগলে তোকে অনেক সুন্দর লাগে, গালটা আপেলের মত টুকটুকে লাল হয়ে যায় রে পাগলী একটু ছুয়ে দেখি। রোজ চিৎকার করে বলছে, টেলিসামাদ তোকে এক ঘুষি পারবো কিন্তুক!
আমার পাগলি টা যখন রেগে যায় তখন বেশি বেশি টেলিসামাদ আর তুইতোকারি করে, আমি তখন খুব মজা পাই, আর আনন্দের সময় বেশি বেশি করে টেলিসামাদ বলে ডাকে।
আমি বললাম, আরে পাগলী তুই যখন তোর আঁচল দিয়ে আমার কপালের ঘাম মুছে দিচ্ছিলি, তখন আমি একটা জান্নাতি সুভাস পাচ্ছিলাম, তাই তোকেই জান্নাতি পাপিয়া বলে ডাকছি।
হঠাৎ রোজ আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো আমাকে ক্ষমা করো সখা, তুমি আমাকে এত ভালোবাসো আগে বুঝতে পারিনি, আমি যে তোমার মুখে অন্য মেয়ের কথা শুনলে মরেই যাবো, আমাকে তোমার বুক থেকে দুরে ঠেলে দিও না সোনা!
আমি বললাম, আত্মা রে আত্মা, আমার লক্ষী পরীর ছাও, আমার কিশোরী পল্লীবালা তোকে ছাড়া অন্য কোন মেয়ের কথা ভাববার সময় কি তুই দিয়েছিস? তুই তো তোর মায়াবী সম্মোহনী শক্তির ধৃষ্টতা দেখিয়ে আমাকে সম্মোহিত করে রেখেছিস! তারপর আমার প্রশান্তিতে চোখের অশ্রু গড়িয়ে রোজের চুল কিছুটা ভিজিয়ে দিলো, পাগলীটা কে জানতেই দিলাম নাহ!
একদিন হাটবারে সকালে হাটে যাওয়ার জন্য বের হলাম। হঠাৎ রাস্তায় পথরোধ করে রোজ দাঁড়িয়ে গেলো। হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললো, আমাকে না বলে হাটে যাচ্ছো টেলিসামাদ। এই নাও আমার জন্য কিছুমিছু নিয়ে আসবে। আমি বললাম আজ তোকে টাকা দিতে হবে না, আজ আমার টাকা দিয়ে তোর জন্য সব কিছু নিয়ে আসবো।
রোজ বলছে, তুমি আবার টাকা পাইছো কোথায়? মার আঁচল থেকে চুরি করছো নিঃসন্দেহে। আমার পল্লীবালার নিজের মা নাই, আর আমার মা ই রোজ কে কোলেপিঠে করে লালনপালন করেছেন, তাই আমার মাকে মা বলেই ডাকে।
রোজ বলছে, সত্যি করে বলতো টেলিসামাদ তুমি টাকা পাইছো কোথায়, বললাম আরে পাগলি আমার জমির ধান আজ হাটে বিক্রি করবো। এবার পাগলি টা বায়না ধরে বলছে, এই পাগল বলোনা আমার জন্য কি কি আনবে। আমি বললাম, বলবো নাহ, বলেই দিলাম ভোঁদৌড়। পাগলীটা রেগে গিয়ে বলছে বলে যা, না বললে এসে আমাকে আর পাবি নাহ মরে যাব কিন্তুক!
আমি দুর থেকে চিৎকার করে বললাম, মার জন্য জাম আর খয়েরী রঙের শাড়ি। রোজ চিৎকার করে বলছে, আমার জন্য কি বলে যা টেলিসামাদ, আমি চিৎকার করে বললাম, তোর জন্য লাল রেশমি চুড়ি, লাল লেজ ফিতা, আলতা আর ছোট্ট কালো টিপ। রোজ আবার চিৎকার করে বলছে এক ডজন নীল রঙের রেশমি চুড়ি অবশ্যই আনবে। ওগো শুনছো, তোমার হবু বউ তোমার উপার্জনের প্রথম উপহারের জন্য অপেক্ষায় থাকবে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে কিন্তুক। আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে, আমার কিশোরী পল্লীবালাকে বউ সাজানোর জন্য সব কিছু নিয়ে এসে তাড়াতাড়ি নতুন বউ কে প্রাণ ভবে দেখবো, এবার মার কাছে যা পাগলি, মা একা আছে বাড়িতে, মার খেয়াল রাখিস।
হাটে গিয়ে মনের মত পছন্দ করে মার জন্য জাম আর খয়েরী রঙের শাড়ি কিনলাম। রোজ এর জন্য লাল রেশমি চুড়ি, লেজ ফিতা, নীল রেশমি চুড়ি, আলতা আর ছোট্ট কালো টিপ কিনে মার পছন্দের গরম গরম জিলাপি কিনে মাত্র হাতে নিয়েছি। তখনই মানুষ জন দৌড়ে পালাচ্ছে, পালাও পালাও পালাও চিৎকার করে বলছে মিলিটারি! মিলিটারি! একজন বলছে সব গ্রামে মিলিটারি ডুকছে, যাকে সামনে পাচ্ছে গুলি করে মারছে, আমি কোন দিকে না তাকিয়ে বাড়ির দিকে দৌড়াতে লাগলাম। মা আর রোজ বাড়িতে তাদের বাঁচাতে হবে।
দৌড়াচ্ছি আর আল্লাহ কে ডাকছি, আল্লাহ আমাকে শক্তি দাও, মাকে আর আমার রোজ কে বাঁচাবার শক্তি দাও আল্লাহ, দয়া করো আল্লাহ। পাগলের মত ছুটতে ছুটতে বাড়িতে পৌঁছে দেখি আমার মার কুড়ে ঘর আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছে। পাগলের মত আগুন ঠেলে মার ঘরের দিকে ছুটছি। পিছন থেকে একজন ঝপটে ধরে বলছে, পাগলামি করিস না ভাই, তোর রোজ কে পাকিস্তানি হায়েনার দল তুলে নিয়ে গেছে পুরান জমিদার বাড়িতে, পারলে তোর রোজ কে বাঁচা।
আমি পাগলের মত পুরান জমিদার বাড়ির দিকে ছুটে চলছি, উন্মাদের মত দৌড়ে পুরান জমিদার বাড়ি কাছাকাছি পৌঁছাতেই চিৎকার করে বলছিলাম আমাকে মেরে ফেলো আমার রোজ কে ছেড়ে দাও হায়নার দল। হঠাৎ হানাদার বাহিনীর একটা বুলেট আমার বুকটা ঝাঁজরা করে দিলো। চিৎকার করে বলছিলাম আমার রোজ কে ছেড়ে দাও!
আমার বুক চিঁড়ে লাল রক্তে ভেসে গেলো আমার মায়ের ভূমি, আমার সবুজ মাতৃভূমি। রোজ – আমার কিশোরী পল্লীবালা আমাকে কক্ষণও ক্ষমা করো না, আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারিনি, আমার যে বুকে মাথা রেখে তুমি শান্তির নীড় গড়েছো, সেই বুকে হায়নার দল বুলেট ছুঁড়ে রক্তের নদী বইয়ে দিলো। পল্লীবালা আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করুন।