মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া গ্যাস কূপে বিস্ফোরণের ২৭ বছর হয়ে গেল শুক্রবার (১৪ই জুন)। এখনও বাংলাদেশ সেই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী মার্কিন প্রতিষ্ঠান অক্সিডেন্টাল থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেনি। বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে নিস্ক্রিয় হলেও দেশের স্বার্থরক্ষার আন্দোলনকারীরা সরব রয়েছেন। ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া এলাকায় ফুলবাড়ী চা-বাগানের সম্মুখভাগে অবস্থিত ১নং গ্যাস অনুসন্ধান কূপে খননকালে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। আকস্মিক এ বিস্ফোরণের পর আগুনের লেলিহান শিখা ৬০০ ফুট উচ্চতায় উঠে যায়। ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য আজও ভাসে মৌলভীবাজার জেলাসহ আশপাশের কয়েকটি জেলার মানুষের মনের চোঁখে।
১৯৯৫ সালে বৃহত্তর সিলেটের ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয় মার্কিনী কোম্পানি অক্সিডেন্টাল অব বাংলাদেশ লিমিটেডের। গ্যাস অনুসন্ধান শুরুর পর কমলগঞ্জবাসীর মনে দেখা দেয় আনন্দ। তেল-গ্যাসে সমৃদ্ধ হবে এলাকা- এমন ভেবে এলাকার মানুষ আনন্দে উল্লসিত হয়। ৩ হাজার ৭০০ মিটার কূপ খনন করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ৮৪০ মিটার খনন করার পরপরই ঘটে স্মরন কালের দুর্ঘটনা। আগুনের লেলিহান শিখা চা বাগান, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, বিদ্যুৎলাইন, সিলেট-আখাউড়া রেলপথ, শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ-শমসেরনগর-ব্রাহ্মণবাজার-কুলাউড়ার সড়কপথ, গ্যাস পাইপলাইন, গ্যাসকুপ, রিজার্ভ গ্যাস, পরিবেশ, পানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মারা যায় হাজার হাজার বন্যপ্রাণী ও পাখি। টানা ১৫ দিন আগুনের সূত্রপাত হয়ে জ্বলার পর যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনের ইন্টারন্যাশনাল অয়েল কোম্পানির বিশেষজ্ঞ রিচার্ড চাইল্ড রি-সহ চার সদস্যের একটি দল আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
তবে পুরো কূপের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগে প্রায় ছয় মাস। মাগুরছড়ায় সংঘটিত ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনার স্মৃতি আজও ভুলতে পারেনি কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার জেলা সহ আশেপাশের জেলার মানুষ। এমন বিপুল পরিমাণ ক্ষতির জন্য এলাকাবাসী কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি।
তেল-গ্যাস বিশেষজ্ঞদের মতে, মাগুরছড়া গ্যাসফিল্ডে ভূগর্ভস্থ উত্তোলনযোগ্য ২৪৫.৮৬ বিসিএফ গ্যাস পুড়ে যায়, যার দাম প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য ক্ষতি আরও ১১ হাজার কোটি টাকা। দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট একাধিক গবেষণা থেকে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। অগ্নিকাণ্ডে মাগুরছড়া ও আশপাশের ৮৭ দশমিক ৫০ একর এলাকা ব্যাপকভাবে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণে ২৯টি চা-বাগানের ৪৬ কোটি ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩০ টাকার ক্ষতি হয়। তাছাড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৬৯.৫ হেক্টর এলাকার ২৫ হাজার ৬৫০টি পূর্ণবয়স্ক গাছ আগুনে পুড়ে যাওয়ায় ক্ষতি হয় প্রায় ৩৩ কোটি ৬১ লাখ টাকার। সরকারের তদন্তে ক্ষতি বাবদ ধরা হয় ৫০৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। এছাড়া বনাঞ্চলের সম্ভাব্য ক্ষতি হয়েছে ৪০ হেক্টর ভূমি এবং ১৫ হাজার ৪৫০টি বৃক্ষ। ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধার পেতে ১০ বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৪৮৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ বনাঞ্চলের মোট ক্ষতি ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৮৫৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। বিস্ফোরণের ফলে ২ হাজার ফুট রেলওয়ে ট্র্যাক পুড়ে ধ্বংস হয়েছে। এতে রাজস্ব ব্যতীত ক্ষতি হয়েছে ৮১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯৫ টাকা।
সড়ক পথের ক্ষতি হয় ২১ কোটি টাকা। গ্যাস পাইপলাইনের ক্ষতি ১৩ লাখ টাকা। বিদ্যুৎ লাইনের ক্ষতি ১ কোটি ৩৫ লাখ ৯ হাজার ১৮৬ টাকা। মাগুরছড়া খাসিয়া পানপুঞ্জির আদিবাসীদের পানের বরজসমূহে প্রতিদিন ৪৭ হাজার ৭৫০ টাকা হারে মোট ক্ষতি ১২ লাখ টাকা।
কমলগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনের ১২৫০ হেক্টর এলাকাকে ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে ঘোষণা করা হয় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। মাগুরছড়া গ্যাসকূপের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এ বনের বিপন্ন বন্যপ্রাণীসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যায়।
গ্যাসকূপ খনন কাজে সাধারণত ‘ডিনামাইট’ জাতীয় বিস্ফোরক ব্যবহার করার নিয়ম থাকলেও অক্সিডেন্টাল মাগুরছড়ার গ্যাস কূপ খনন কাজে বিস্ফোরক হিসেবে প্রাণঘাতী ও পরিবেশবিনাশী তেজস্ক্রিয়যুক্ত ‘রেডিও অ্যাকটিভ সোর্স’ ব্যবহার করেছিল বলে অভিযোগ করেছে জাতীয় তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির সংশ্লিষ্টরা। অক্সিডেন্টালের খনন কাজের আনাড়িপনা, অনভিজ্ঞতা, দায়িত্বে অবহেলার উদাসীনতার, অযোগ্যতার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে ওই কমিটির অভিমত।
মাগুরছড়া অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে আন্দোলন এখনও চলমান। প্রতি বছর ১৪ জুন এ এলাকার সাধারণ মানুষ মানববন্ধনসহ নানা কর্মসুচি পালন করে আসছে। ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন বিস্ফোরণের পর ছয় মাসের অধিককাল ধরে জ্বলতে থাকা কুপের উৎস মুখ সিল করার কাজ সম্পন্ন হয় ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি। তার আগেই ১৯৯৭ সালের ২০ ডিসেম্বর অক্সিডেন্টাল মাগুরছড়া থেকে বিদায় নেয়। এ অবস্থায় এলাকায় জনগণের মধ্যে দেখা দেয় তীব্র প্রতিক্রিয়া।
১৯৯৮ সালের ১০ জানুয়ারি রাস্তায় বড় বড় গাছ ফেলে ব্যারিকেড তৈরি ও প্রতিবাদ করে হাজার হাজার মানুষ। সাধারণ মানুষ শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ-মৌলভীবাজারসহ সমগ্র সিলেট বিভাগ ও দেশের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, পদযাত্রা করে।
মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির মন্ত্রী জিডিসন প্রধান সুচিয়াং বলেন, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক বনের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা কেউ বুঝতে পারেনি। আমরা যারা এ বনে বসবাস করছি তারা বুঝতে পারছি।
এ বিষয়ে মাগুরছড়া তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মাগুরছড়া গ্যাসকূপে অগ্নিকাণ্ডের পর যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সে কমিটি এক মাসের মধ্যেই তদন্ত রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। ওই রিপোর্ট বীমা কোম্পানিতে জমা দিয়ে অক্সিডেন্টাল তাদের বীমাকৃত যন্ত্রাংশ, রিগ ইত্যাদির ক্ষতিপূরণ আদায় করে নেয়। কিন্তু কোম্পানির কাছ থেকে সরকার বা এলাকাবাসী এখনও কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। সরকার আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হলে অক্সিডেন্টাল থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব বলে মনে করেন সৈয়দ আমিরুজ্জামান।
লাউয়াছড়া বনরেঞ্জ কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, বনের ক্ষতি নিরূপণ করা হলেও এ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কোনো সময়ে পুষিয়ে ওঠার নয়। আমার জানামতে মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণে কোনো ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়নি। বন ও পরিবেশের এই ক্ষতিপূরণ আদায় নিশ্চিত হওয়া আমাদেরও দাবি।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম বলেন, মাগুরছড়ায় অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারে আমার কাছে ক্ষতিপূরণের কোনো আবেদন জমা নেই। ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিয়ে কেউ আমার কাছে আসেনি। পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপারে আগের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
আজ ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | হেমন্তকাল | ২০শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি | রাত ১১:১৭ | শুক্রবার
ডিবিএন/এসই/ মোস্তাফিজুর রহমান (বাপ্পি)