ফায়ারম্যান সোহেল রানার জন্ম হয়েছিল কৃষক পরিবারে। কষ্টে উৎপাদন করা ফসল বিক্রি ও মায়ের জমানো টাকা দিয়ে মাধ্যমিক পাস করেন। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় ছোট বোন ও তিন ভাইকে মানুষ করার দায়িত্ব নিতে হয় তাঁকে।
বাবা নুরুল ইসলাম বেঁচে থাকলেও ১০ বছর আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। বাঁ পা চিকন হয়ে কাজ করার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। তাই পুরো পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়েছে সোহেল রানাকে।
সোহেল রানার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার চৌগাংগায়। ২০১০ সালে চৌগাংগা শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। এরপর থেকে পরিবারের দায়িত্ব চলে আসে। ছোট বোন সেলিনা আকতার, তিন ভাই উজ্জ্বল, রুবেল ও দেলোয়ারকে লেখাপড়া করানোর দায়িত্ব পড়ে তাঁর ওপর। কিন্তু অর্থের অভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না তাঁর। তাই অটোরিকশা চালিয়ে আর প্রাইভেট পড়িয়ে খরচ জোগাতেন সোহেল।
পরে ২০১৪ সালে করিমগঞ্জ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। সে সময় পরিবারের হাল ধরতে ২০১৫ সালে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সে ফায়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন সোহেল রানা। তাঁর রোজগারের টাকা দিয়েই চলে আসছিল পুরো পরিবার। তাঁর মৃত্যুতে পুরো পরিবার অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে বলে জানান বন্ধু ও সমবয়সী চাচাতো ভাই শহিদুল ইসলাম সাইদ।
সারা রাত সংবাদের অপেক্ষায় থেকে সোমবার ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে সোহেল রানার মৃত্যুর খবর শুনতে পায় তাঁর পরিবার। এরপর থেকে মা-বাবাসহ পুরো পরিবারে নেমে আসে শোক।
‘আমি সাইন দিলাম ক্যারে। সাইনডা না দিলে আমার বাজান আমার সাথে বাসায় থাকত।’ ছেলেকে হারিয়ে বাড়ির উঠানে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন আর এমন প্রলাপ বকছিলেন সোহেল রানার মা হালিমা খাতুন। সোহেল রানাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানোর আগে হালিমার স্বাক্ষর নিয়েছিলেন চিকিৎসকরা।
সোহেল রানার বাবা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘সোহেলের স্বপ্ন ছিল ছোট ভাইয়েরে ঢাকায় নিয়া ভালো কলেজে ভর্তি করব। আজ সোহেল নাই। এহন কে নিব আমার পোলারে পড়াইতে।’
এদিকে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সিঙ্গাপুরে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে সোহেল রানার মরদেহ আজ রাতে দেশে ফেরত আনা হবে। এরপর আগামীকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টায় উপপরিচালকসহ ৫৪ জন সদস্য উপস্থিত থেকে সোহেল রানাকে গার্ড অব অনার দেবেন।
গত ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীতে পুড়তে থাকা এফআর টাওয়ারে আটকেপড়া মানুষের জীবন বাঁচাতে গিয়ে গুরুতর আহত হন কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনের ফায়ারম্যান সোহেল রানা। তাঁর পা ভেঙে তিন টুকরা হয়ে যায়। ছিদ্র হয়ে যায় পেটের নাড়িভুঁড়ি। দ্রুত তাঁকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়।
এখানে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ৫ এপ্রিল সোহেল রানাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্থানীয় সময় গতকাল রোববার দিবাগত রাত ২টা ১৭ মিনিটে মারা যান তিনি।