ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে গেছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে জিডিপি বৃদ্ধির হার নেমে এসেছে ৪.৫ শতাংশে। ভারত সরকারের এক হিসাবে বলা হয়েছে, অক্টোবরে আটটি প্রধান অবকাঠামো ক্ষেত্রের উৎপাদন সরাসরি ৫.৮ শতাংশ কমেছে। আর অর্থ বছরের প্রথম সাত মাসেই রাজকোষ ঘাটতি ৭.২ লাখ কোটি রুপিতে পৌঁছেছে। যা পুরো বছরের আনুমানিক রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণের চেয়েও বেশি।
স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় দেশের আর্থিক বৃদ্ধির গড় হার ৩.৫ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করেছিল। তাকে ব্যঙ্গ করে ‘হিন্দু রেট অব গ্রোথ’ তকমা দেন অর্থনীতিবিদ রাজ কৃষ্ণ। সেই তকমা জনপ্রিয় হয়েছিল। মোদি সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরই জুলাইয়ে সংসদে আর্থিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন নতুন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। তিনি তখন বলেছিলেন, কংগ্রেস আমলে অর্থনীতি কেন দ্বিগুণ হয়নি? তখন কেন হিন্দু রেট অব গ্রোথ চাপানো হয়েছিল! এবার মোদি জমানাতেই বৃদ্ধির হার ৪.৫ শতাংশে নেমে আসায় প্রশ্ন উঠছে, ‘হিন্দু রেটেই’ কি ভারত ফিরে যাচ্ছে?জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ)-এর অর্থনীতির অধ্যাপিকা জয়তী ঘোষের মন্তব্য, হিন্দু রেট অব গ্রোথে তো তাও ৩.৫ শতাংশ বৃদ্ধির হার ছিল। এখন কি বৃদ্ধি আদৌ হচ্ছে? না কি অর্থনীতির সংকোচন হচ্ছে? বেকারত্বের হার, সংসারের খরচ কমে যাওয়া, গাড়ি থেকে নিত্য প্রয়োজনের জিনিসপত্রের বিক্রি কমা, একের পর এক সংস্থার ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার মতো অর্থনীতির অন্যান্য মাপকাঠি কিন্তু সে কথাই বলছে।জয়তী বলছেন, মোদি জমানায় জিডিপি মাপার পদ্ধতি বদলে দেয়া হয়। সেই পদ্ধতি নিয়েই বিতর্ক রয়েছে। বস্তুত মোদি সরকারের সাবেক প্রধান আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যনই বলেছিলেন, নতুন পদ্ধতিতে জিডিপি মাপায় তা ২ থেকে ২.৫ শতাংশ অঙ্ক বেশি হচ্ছে। তার কথা মানলে আদতে আর্থিক বৃদ্ধির হার ২ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে।কেন এই হাল? বাজারে বিক্রি কমেছে। কারখানার উৎপাদনে অধোগতি। বেসরকারি লগ্নি আসছে না। বিশ্ববাজারে ঝিমুনির ফলে রপ্তানিতেও ভাটার টান। অর্থনীতির চারটি ইঞ্জিনই ঠিক মতো না চলায় তার ধাক্কা লেগেছে অর্থনীতিতে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ অর্থনীতির এই অবস্থাকে ‘গভীরভাবে উদ্বেগজনক’ বলে বর্ণনা করেছেন।মোদি সরকার ক্ষমতায় ফিরে ৫ লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতির স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু গত ছয় বছরে অর্থনীতির অবস্থা এতখানি খারাপ হয়নি। ২০১২-১৩-র জানুয়ারি-মার্চে বৃদ্ধির হার ৪.৩ শতাংশে নেমে এসেছিল। সেই অর্থ বছরে বৃদ্ধির হার মাত্র ৪.৫ শতাংশ ছিল। চলতি অর্থ বছরের প্রথম তিন মাস, এপ্রিল থেকে জুনে বৃদ্ধির হার ছিল ৫ শতাংশ। পরের তিন মাসে তা ৪.৫ শতাংশে নেমে আসায় এই অর্থ বছরে বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের গণ্ডি টপকাতে পারবে কিনা, তা নিয়েই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ অর্থ বছরের প্রথম ছয় মাসে বৃদ্ধির হার মাত্র ৪.৮ শতাংশ। যা গত বছরে ছিল ৭.৫ শতাংশ।আর্থিক বিষয় সচিব অতনু চক্রবর্তীর দাবি, আইএমএফ-ই বলেছে এ বছর বৃদ্ধির হার ৬.১ শতাংশে পৌঁছবে। আগামী অর্থ বছরে ৭ শতাংশ হবে। শেয়ার বাজারে লগ্নির আগমনও ইতিবাচক। তার সুরেই প্রধান আর্থিক উপদেষ্টা কে ভি সুব্রহ্মণ্যনের দাবি, অর্থনীতির ভিত মজবুতই রয়েছে। অক্টোবর-ডিসেম্বর ত্রৈমাসিক থেকেই বৃদ্ধির হার বাড়তে শুরু করবে।অর্থনীতিতে ঝিমুনি ধরার পরে হাল শোধরাতে অর্থমন্ত্রী ইতোমধ্যেই একাধিক চেষ্টা করেছেন। কর্পোরেট করের হার ৩০ থেকে কমিয়ে ২২ শতাংশ করা হয়েছে। নতুন কারখানার ক্ষেত্রে করের হার ১৫ শতাংশে কমিয়ে আনা হয়েছে। সুব্রহ্মণ্যন বলেন, লগ্নির গতি বাড়াতে এই কর্পোরেট কর ছাঁটাই দরকার ছিল। কিন্তু অর্থনীতিবিদ অরুণ কুমারের প্রশ্ন, কর্পোরেট সংস্থাগুলো যদি নিজেদের কারখানার পণ্য বাজারে বিক্রিই করতে না পারে, মানুষের আয় কমে যাওয়ার ফলে যদি বাজারে বিক্রি না হয়, তাহলে শিল্পমহল নতুন লগ্নি করবে কেন?সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, জুলাই-সেপ্টেম্বরে বৃদ্ধির হার ৪.৫ শতাংশে নেমে আসার মূল কারণ কারখানার উৎপাদন ০.৪ শতাংশ কমে যাওয়া। কারখানার পাশাপাশি গৃহস্থ বাড়ি এবং কৃষিতে বিদ্যুতের চাহিদা কমেছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনও কমেছে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ভারি বৃষ্টি ও দেরিতে বর্ষা শেষ হওয়ায় খনি এবং নির্মাণেও উৎপাদন কমেছে। আটটি প্রধান অবকাঠামো ক্ষেত্রে উৎপাদন সেপ্টেম্বরেই ৫.২ শতাংশ সরাসরি কমেছিল। অক্টোবরে তা আরও বেশি মাত্রায় কমেছে।অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, অর্থ মন্ত্রণালয় ফের রিজার্ভ ব্যাংকের ওপর সুদ কমানোর জন্য চাপ তৈরি করবে। এ নিয়ে রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস সংসদে এসে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। বাজারের প্রত্যাশা, ডিসেম্বরে রিজার্ভ ব্যাংক ২৫ বেসিস পয়েন্ট সুদ কমাতে পারে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে? কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সুরজেওয়ালার কটাক্ষ, মোদি সরকারের কাছে জিডিপি-র অর্থ এখন গডসে ডিভাইড পলিটিক্স। সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, সব পদে ইয়েস ম্যান বসিয়ে, চাষীদের সংকট থেকে চোখ-কান বুজে থাকার ফল। এটা মোদির তৈরি বিপর্যয়।বৃদ্ধির এই হারের পরে ২০২৪-২৫ এ ৫ লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতির স্বপ্ন পূরণ হবে কি? সাবেক অর্থসচিব সুভাষচন্দ্র গর্গের মন্তব্য, সংখ্যার হিসাবে জুলাই-সেপ্টেম্বরে বৃদ্ধির হার ৬.১ শতাংশে নেমে এসেছে। নতুন লগ্নিতে বৃদ্ধির হার মাত্র ০.৯ শতাংশ। পুরো বছরে সংখ্যার হিসেবে বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ ছাড়াবে না। ফলে ৫ লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতির লক্ষ্যপূরণও অন্তত এক বছর পিছিয়ে যাবে।
সুত্র : আর টি ভি